নবম অধ্যায়
রাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযােগ
বলিব তােমারে আমি জ্ঞান সবিজ্ঞান।
হিংসাশূন্য হয়ে যাতে দুঃখে পাবে ত্রাণ ।।১
অতিগুহ্য’রাজুবিদ্যা পবিত্র অক্ষয়।
অপরােক্ষ ধর্মময় সুখমধ্যে হয়।।২
এই জ্ঞানে শ্রদ্ধাহীন না পায় আমারে।
মৃত্যুময় এ সংসারে ঘােরে বারে বারে।।৩
সরলার্থঃ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন- হে অর্জুন, আমি বিজ্ঞানের সহিত ঈশ্বর বিষয়ক জ্ঞানের কথা বলিতেছি। ইহা জানিলে তুমি হিংসাশূন্য হইবে এবং সংসার দুঃখ হইতে মুক্তি পাইবে। ১ এই জ্ঞানের নাম রাজবিদ্যা। ইহা পবিত্র, অক্ষয়-ও অতি গােপনীয়। ইহা অপরােক্ষ ও সুখদায়ক। ২ যে ব্যক্তি এই জ্ঞান বিষয়ে শ্রদ্ধাহীন, সে আমাকে পায় না। তিনি মৃত্যুময় এই সংসারে বারবার যাতায়াত করেন । ৩
অব্যক্ত মূর্তিতে আমি বিশ্বব্যাপ্ত রই।
ভূতগণ আমাস্থিত আমি ভূতে নই।।৪
ধারক-পালক আমি সৃষ্টি ও সৃষ্টের।
নই আমি অবস্থিত ভিতরে তাদের।।৫
আকাশেতে থাকে যথা বায়ু সর্বময় ।
ভূতগণ সেইরূপ আমাতেই রয়।।৬
প্রকৃতিতে ভূতগণ প্রলয়ে বিলয় ।
কল্পারম্ভে পুনঃ পার্থ সৃজি সমুদয়।।৭
সরলার্থঃ আমি অব্যক্তরূপে বিশ্ব ব্যাপিয়া আছি। ভূতগণ আমাতে অবস্থিত আছে, কিন্তু আমি ভূতগণে অবস্থিত নহি। ৪ আমার ঐশ্বরিক যােগ দেখ। আমি ভূতগণের ধারক ও পালক। কিন্তু আমি ভূতগণে অবিস্থত নই। ৫ সর্বগামী বাতাস যেমন আকাশে অবস্থিত সেইরূপ সৃষ্টি ও সৃষ্ট প্রাণীরা আমাতেই অবস্থিত থাকে ।৬ প্রলয়কালে ভূতগণ প্রকৃতিতে লয়প্রাপ্ত হয়। কল্পের আরম্ভে আমি তাহাদিগকে আবার সৃষ্টি করি ।৭
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন
আমি করি অধিষ্ঠান মায়াতে আমার।
কর্মাধীন জীবগণে সৃজি বার বার।। ৮
সৃষ্টিকর্ম করি আমি হয়ে উদাসীন।
তাই পার্থ কভু মাের ঘটে না বন্ধন।।৯
প্রকৃতি সৃজয়ে এই বিশ্ব চরাচর।
এ কারণে হয় পার্থ সৃষ্টি বার বার।।১০
নররূপধারী মােরে তুচ্ছে মূর্খ নর।
জানে না পরম ভাব-আমি মহেশ্বর।।১১
সরলার্থঃ আমি আমার নিজের মায়া দ্বারাই কর্মাধীন। জীবগণকে বার বার সৃষ্টি করি। ৮ হে অর্জুন, আমি অনাসক্ত হইয়াই সৃষ্টি করি। এই জন্য আমার কর্মে বন্ধন ঘটে না। ৯ হে অর্জুন, প্রকৃতিই এই বিশ্বচরাচর সৃষ্টি করিয়া থাকে। তাই বার বার সৃষ্টি হয়। ১০ আমি যে মহেশ্বর তাহা মূর্খ ব্যক্তি বুঝিতে পারে না । বুঝিতে পারে না বলিয়াই সে নররূপধারী আমাকে তুচ্ছ বােধ করে। ১১
আশা, কর্ম, জ্ঞানে ব্যর্থ যেই মূঢ় নর।
আসুরী প্রকৃতি লভে অতি মােহকর।।১২
দৈবী প্রকৃতির বশে মহাজনগণ।
সনাতন জানি মােরে ভজে একমন।।১৩
নিয়ম যতন কিংবা প্রণাম করিয়া।
নিত্যযুক্ত পুজে মােরে দৃঢ় ভক্তি দিয়া।।১৪
জ্ঞানযজ্ঞে কেহ করে আমার ভজন।
এক ভিন্ন বহুভাবে করয়ে পূজন।।১৫
সরলার্থঃ মূর্খ ব্যক্তি আসুরী প্রকৃতির বশবর্ত্তী হইয়াই এইরূপ করে। তাহার আশা, কর্ম ও জ্ঞান সবই বৃথা হয়। তাহার চিত্তও বিক্ষিপ্ত থাকে। ১২ মহাপুরুষগণ দৈবী প্রকৃতির বশে অনন্যচিত্ত হইয়া থাকেন। তাঁহারা আমাকে সনাতন বলিয়া জানিয়া একমনে আমারই ভজনা করেন। ১৩ তাঁহারা নিয়ম, যত্ন ও প্রণাম করিয়া প্রতিদিন ভক্তির সহিত আমার ভজনা করেন। ১৪ কেহ জ্ঞানযজ্ঞে আমার ভজনা করে। কেহ কেহ আবার নানাভাবে আমার উপাসনা করেন। ১৫
ক্রতু যজ্ঞ মহৌষধ স্বধা মন্ত্র আমি।
আমি অগ্নিহােম ঘৃত জেনে রেখাে তুমি।।১৬
পিতামাতা জগতের কর্ম-ফলদাতা।
পবিত্র ওঙ্কার আমি পিতামহ ধাতা।।১৭
প্রভু সাক্ষী গতি ভর্তা নিবাস শরণ।
প্রভব প্রলয় স্থান আমিই ত কারণ ৷ ৷১৮
সরলার্থঃ আমি ক্রতু, আমি যজ্ঞ, আমি মন্ত্র, আমি স্বধা, আমি অগ্নি, আমি হােম, আমিই ঘৃত। তুমি ইহা জানিয়া রাখিও। ১৬ আমি জগতের পিতামাতা। আমি কর্মের ফলদাতা। আমি পবিত্র ওঙ্কার। আমি পিতামহ। আমি বিধাতা। ১৭ আমি প্রভু, আমি সাক্ষী, আমি গতি, আমি ভর্তা, আমি প্রভা ও প্রলয়ের স্থান। আমি সব কিছুর কারণ। ১৮
তাপকারী আমি করি জল বরিষণ।
স্থূল সূক্ষ্ম আমি পার্থ জীবন-মরণ।।১৯
যজ্ঞ করি-সােমপায়ী স্বর্গসুখ চায়।
লাভ করি ইন্দ্রলােক দেবভােগ্য পায়।।২০
স্বর্গভােগে পুণ্যশেষ জন্ম পুনরায় ।
এভাবে সকামীগণ আসে আর যায়।।২১
সরলার্থঃ হে অর্জুন, আমি তাপ দান করি, আমি জল বর্ষণ করি, আমি স্থূল ও সূক্ষ, আমি জীবের জন্ম এবং আমিই জীবের মৃত্যু। ১৯ সােমপায়ী ব্যক্তি যজ্ঞ করিয়া স্বর্গসুখ লাভ করিতে চায়। সে ইন্দ্রলােকে গিয়া দেবভােগ্য লাভ করে। ২০ পুণ্য শেষ হইলে ঈদৃশ ব্যক্তির সুখভােগও শেষ হয়। এভাবে সকামী ব্যক্তি বার বার সংসারে জন্মগ্রহণ করে আর মারা যায়। ২১
একমনে যেবা করে ভজনা আমার।
আমিই বহিয়া থাকি যােগক্ষেম তার।।২২
পার্থ ভক্তিসহ যে-ই অন্য দেবে ভজে।
বিধিহীনভাবে সে-ও আমারেই পূজে ৷ ৷২৩
সর্বযজ্ঞ ভােক্তা আমি ফলদাতা আর।
তা না জেনে মােরে মূর্খ ভাবে বার বার ৷ ৷২৪
সরলার্থঃ যে ব্যক্তি এক মনে আমার ভজনা করে আমি তাহার যােগক্ষেম বহন করিয়া থাকি ।২২ হে অর্জুন, যে ব্যক্তি ভক্তির সহিত অন্য দেবতার পূজা করে সেই ব্যক্তিও বিধিহীনভাবে আমারই ভজনা করে। ২৩ আমি সর্বযজ্ঞের ভােক্তা ও কর্মের ফলদাতা। মূর্খ ব্যক্তি তাহা না জানিয়া বার বার সংসারে ঘুরিয়া থাকে ।২৪
দেবে পূজি স্বর্গ, শ্রাদ্ধে পিতৃলােক পায়।
ভূতে পূজি ভূতলােক মদ্-ভক্ত আমায়।।২৫
পত্র পুষ্প ফল জল ভক্তিতে অর্পিলে।
গ্রহণ করিয়া থাকি আমি সে সকলে।।২৬
তপ কর্ম হােম খাদ্য আর যত দান ।
কর পার্থ সে সকল আমারে অর্পণ।।২৭
সরলার্থঃ অন্য দেবতাকে পূজা করিয়া স্বর্গ পাওয়া যায়। শ্রাদ্ধ করিয়া পিতৃলােক পাওয়া যায়, ভূতগণের পূজা করিয়া ভূতলােক পাওয়া যায়। কিন্তু আমার ভক্ত আমাকে পায়। ২৫ পত্র, পুষ্প, ফল, জল ভক্তির সহিত আমাকে অর্পণ করিলে আমি সেই সকল গ্রহণ করিয়া থাকি। ২৬ হে অর্জুন, তপস্যা, কর্ম, হােম, খাদ্য, দান-সমস্তই আমাতে অর্পণ কর।২৭
শুভাশুভ কর্মফলে তাতে মুক্ত হবে।
সন্ন্যাস-যােগের বলে আমাকেই পাবে।।২৮
মাের কাছে সবে সম প্রিয়াপ্রিয় নাই।
আমি তার সে আমার যে-ভজে আমায়।।২৯
দুষ্ট যদি পূজে মােরে হয়ে একমন।
কর্মনিষ্ঠা সাধু তার সাধু সেই জন।।৩০
ধর্ম-আত্মা হইয়া সে নিত্য সুখে রয়।
মাের ভক্ত কভু পার্থ বিনষ্ট না হয়।।৩১
সরলার্থঃ তাহাতে তুমি শুভাশুভ কর্মফল হইতে মুক্ত হইবে এবং সন্ন্যাসযােগের দ্বারা আমাকে পাইবে। ২৮ আমার কাছে প্রিয়-অপ্রিয় নাই। আমার কাছে সকলেই সমান। যে আমার ভজনা করে, আমি তাহার এবং সেও আমার ।২৯ দুষ্ট ব্যক্তিও যদি একমনে আমার পূজা করে তবে তাহার কর্মনিষ্ঠা সাধু হয় এবং সেই দুষ্ট ব্যক্তিও সজ্জন বলিয়া পরিগণিত হয় ।৩০ সে ধর্মপ্রাণ হইয়া চিরদিন সুখে থাকে। হে অর্জুন, যিনি আমার ভক্ত, তিনি কখনও নাশপ্রাপ্ত হন-না। ৩১
বৈশ্য শূদ্র নারী কিংবা অতি হীন জাতি।
আমারে পূজিয়া পার্থ লভে শ্রেষ্ঠগতি।।৩২
পাবে মােরে পুত বিপ্র ক্ষত্রিয় সুজন।
পূজ ভবে মােরে পার্থ সদা দিয়া মন।।৩৩
ভক্তিভরে নমঃ মােরে সমাহিত মন।
নিশ্চয় পাইবে মােরে কুরুর নন্দন।।৩৪
সরলার্থঃ শূদ্র, বৈশ্য, নারী, এমন কি হীনজাতির লােকও যদি আমার ভজনা করেন, তখন তাঁরাও শ্রেষ্ঠগতি লাভ করেন। ৩২ ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ এবং সজ্জন ব্যক্তিগণ আমাকে পাইবে। অতএব, হে অর্জুন তুমি সর্বদা একমনে নিষ্ঠারসাথে আমার-ভজনা কর। ৩৩ হে অর্জুন, সেই সাথে তুমি ভক্তির-সহিত আমাকেই নমস্কার কর, তুমি নিশ্চিত আমাকেই পাইবে।৩৪
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার নবম অধ্যায়ের সার-সংক্ষেপ
ঈশ্বরের দুইটি ভাব – নির্গুণ ও সগুণ । নির্গুণভাবে ঈশ্বর নিরাকার। সগুণভাবে তিনি সাকার। ভক্তির সহিত সাকার ঈশ্বরের উপাসনা করিলেও মুক্তি লাভ হয়। পত্র, পুষ্প, ফল, জল– যাহাই ভক্তির সহিত ঈশ্বরকে নিবেদন করেন তিনি তাহাই গ্রহণ করেন। অতএব ঈশ্বরকে পাওয়ার শ্রেষ্ঠ উপায় ভক্তি। সমস্ত কর্মফল ঈশ্বরে অর্পণ করিলে কর্মবন্ধন ঘটে না। ঈশ্বরে মনপ্রাণ নিবদ্ধ করিয়া কর্ম করিলে তাহা ভক্তির সহায়ক হয়। কিন্তু ইহা খুব গােপনীয়। ইহাই রাজবিদ্যা- রাজগুহ্যযােগ।
ইতি রাজবিদ্যা-রাজগুহ্যযােগ নামক নবম অধ্যায়।
আরো পড়ুন:
মঙ্গলাচরণ | প্রথম অধ্যায় | দ্বিতীয় অধ্যায় | তৃতীয় অধ্যায় | চতুর্থ অধ্যায় | পঞ্চম অধ্যায় | ষষ্ঠ অধ্যায় | সপ্তম অধ্যায় | অষ্টম অধ্যায় | দশম অধ্যায় | একাদশ অধ্যায় | দ্বাদশ অধ্যায় | ত্রয়োদশ অধ্যায় | চতুর্দশ অধ্যায় | পঞ্চদশ অধ্যায় | ষােড়শ অধ্যায় | সপ্তদশ অধ্যায় | অষ্টাদশ অধ্যায় | সংক্ষিপ্ত-মাহাত্ম্যম | সম্পূর্ণ-মাহাত্ম্যম | ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র।
0 মন্তব্যসমূহ