দশম অধ্যায়
বিভূতিযােগ
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন
পরমার্থ কথা পার্থ শােন পুনরায় ।
প্রীত হও, তাই কহি হিত কামনায়।।১
জানেনা উদ্ভব মাের মহর্ষি-দেবাদি।
সর্বরূপে আমি হই সকলের আদি ৷ ৷২
অজ ও অনাদি আমি লােক-মহেশ্বর।
তাহা জানি হয় ভবে পাপমুক্ত নর।।৩
সরলার্থঃ শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন—হে অর্জুন, তােমাকে আমার পরমার্থ তত্ত্ব বলিতেছি। শুনিলে তুমি প্রীত হইবে। তাই বলিতেছি ।১ মহর্ষিগণ আমার এই পরমার্থতত্ত্ব জানেন না। সমস্ত ভাবেই আমি সকলের আদি।২ আমার জন্ম নাই। আদি অনাদি ও সর্বলােক মহেশ্বর। যে ব্যক্তি এই তত্ত্ব জানে সে পাপমুক্ত হয়।৩
বুদ্ধি, জ্ঞান, অমূঢ়তা, ক্ষমা, সত্য দম।
জন্ম-মৃত্যু সুখ-দুঃখ নিন্দা যশ শম।।৪
অহিংসা, সমতা, তুষ্টি তপঃ দান ভয়।
আমা হতে পায় জীব ভাব সমুদয় ৷ ৷৫
সপ্ত-ঋষি আর পূর্ব মনু চারিজন।
মাের ভাবে জন্মি করে প্রজার সৃজন।।৬
এ মাের বিভূতি যােগ যে জন জানয়।
অচল সমাধি-যােগে সেই যুক্ত হয়।।৭
সরলার্থঃ বুদ্ধি, জ্ঞান, অমূঢ়তা, ক্ষমা, সত্য, শম, দম, জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ, নিন্দা, যশ, অহিংসা, সমতা, তুষ্টি, তপঃ, দান, ভয়—এই কয়টি জীবের ভাব। জীবগণ আমা হইতেই এই ভাবগুলি পাইয়া থাকে ।৪-৫ সপ্ত-ঋষি ও পূর্ব চারি মনু আমার মানস-সৃষ্টি। তাহারা প্রজা সৃষ্টি করিয়াছেন। ৬ যে ব্যক্তি আমার বিভূতি যােগ জানে সে ব্যক্তি সমাধি যােগে রত হয়। ৭
আমা হতে জগতের সৃষ্টি প্রবর্তন।
তাহা জানি করে জ্ঞানী আমার ভজন।।৮
মন-প্রাণ করি ভক্ত আমারে অর্পণ।
শান্তি-তৃপ্তি তরে করে প্রসঙ্গ কীর্তন।।৯
সেই সব সদাযুক্ত প্রিয় ভক্তগণে।
বুদ্ধিযােগে দেই যথা চাহে মাের মনে।।১০
আত্মাভাবে করি আমি তাহে অবস্থান।
অনুগ্রহ করে থাকি দিয়া তত্ত্বজ্ঞান।।১১
সরলার্থঃ আমা হইতে জগতের প্রবর্তন তাহা জানিয়া জ্ঞানী ব্যক্তি আমার ভজনা করে ।৮ আমার ভক্ত আমাতে মন-প্রাণ সমৰ্পণ করিয়া শান্তি ও তৃপ্তি লাভের জন্য আমার প্রসঙ্গ কীর্তন করে। ৯ আমি সেই সকল ভক্তকে আমার মনমত ভক্তি দিয়া থাকি । সেই জ্ঞানের সাহায্যে তাহারা আমাকে লাভ করেন ।১০ আমি আত্মারূপে তাহাদের মধ্যে বাস করি এবং অনুগ্রহ করিয়া তাহাদিগকে তত্ত্বজ্ঞান দান করি। তাহাদের অজ্ঞানতা জনিত অন্ধকার দূর করি ।১১
অর্জুন কহিলেন
পরব্রহ্ম পরম পুরুষ শাশ্বত।
আদিদেব অজ বিভু তুমি অনন্ত।।১২
দেবর্ষি নারদ ব্যাস অসিত দেবল।
তাহারা বলেন যাহা তুমিও তা বল ৷ ৷১৩
সত্য বটে যা কহিলে তুমি হে কেশব।
দৈত্য দেবে নাহি জানে তােমার উদ্ভব।।১৪
জগতের পতি দেব ভুতেশ ভাবন।
তুমিই তােমাকে জান ওহে নারায়ণ।।১৫
সরলার্থঃ অর্জুন বলিলেন— হে কৃষ্ণ, পরব্রহ্ম, পরধাম, শাশ্বত-পুরুষ, আদিদেব, অজ, বিভু— সবই তুমি। ১২ দেবর্ষি নারদ, ব্যাস, অসিত, দেবল প্রভৃতি যাহা বলেন তুমিও তাহাই বল।১৩ তুমি যে বলিলে, দেবগণ ও দৈত্যগণ তােমার উৎপত্তি জানেনা— তুমি ইহা ঠিকই বলিয়াছ।১৪ তুমি জগতের পতি। তুমি ভূতগণের প্রভু। তুমি ছাড়া আর কেহ তােমাকে জানিতে পারে না। ১৫
বিশ্বময় বিরাজিত বিভূতি তােমার।
কহ মােরে সে বিভূতি করিয়া বিস্তার।।১৬
কিভাবে ভাবি তােমা কহ ভগবান।
কহ মােরে কি কি ভাবে করিব চিন্তন।।১৭
বিস্তারিয়া বল কৃষ্ণ বিভূতি তােমার।
বাসনা হৃদয়ে মাের শুনি বার বার।।১৮
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন
শুন পার্থ কহিতেছি বিভূতি আমার।
এ অনন্ত বিভূতির শেষ নাহি আর।।১৯
সরলার্থঃ বিশ্বময় কেবল তােমারই বিভূতি। তােমার বিভূতির কথা আমাকে বিস্তৃতভাবে বল। ১৬ তােমাকে কিভাবে ভাবিব ও কিভাবে চিন্তা করিব তাহা আমাকে খুলিয়া বল। ১৭ তােমার বিভূতির কথা শুনিতে আমার খুবই ইচ্ছা হইতেছে। তুমি তাহা খুলিয়া বল। ১৮ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন- হে অর্জুন, আমার বিভূতির শেষ নাই, বলিতেছি শুন।১৯
আত্মারূপে আমি-পার্থ সর্বভূতে রই।
সকল জীবের আদি অন্ত মধ্য হই ৷ ৷২০
আদিত্যেতে বিষ্ণু আমি, তপন জ্যোতিতে।
মরীচি মরুৎগণে, চন্দ্র নক্ষত্রেতে।।২১
বেদমধ্যে সাম, আমি ইন্দ্রিয়েতে মন।
দেবেতে বাসব আমি, জীবেতে চেতন ৷ ৷২২
সরলার্থঃ হে অর্জুন, আমি আত্মারূপে সকলের মধ্যে বিরাজ করি। ভূতগণের আদি, অন্ত ও মধ্য সমস্তই আমি। ২০ আমি আদিত্যগণের মধ্যে বিষ্ণু, জ্যোতিঙ্কের মধ্যে তপন, মরুৎগণের মধ্যে মরীচি, নক্ষত্রগণের মধ্যে চন্দ্র। ২১ আমি বেদের মধ্যে সামবেদ। ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে মন, দেবগণের মধ্যে ইন্দ্র ও জীবগণের মধ্যে চেতনা ।২২
পর্বতে সুমেরু আমি, যক্ষেতে কুবের।
বসুতে অনল আমি, রুদ্রেতে শঙ্কর।।২৩
বৃহস্পতি বটি আমি, শ্রেষ্ঠ পুরােহিতে।
জলাশয়ে রত্নাকর, স্কন্দ সেনানীতে ৷ ৷২৪
মহর্ষিতে ভৃণ্ড আমি, বাক্যেতে ওঙ্কার।
যজ্ঞে জপ যজ্ঞ হই, হিমাদ্রি স্থাবর।।২৫
নারদ দেবর্ষি মধ্যে, কপিল সিদ্ধেতে।
গন্ধর্বতে চিত্ররথ অশ্বথ বৃক্ষেতে।।২৬
সরলার্থঃ আমি পর্বতের মধ্যে সুমেরু, যক্ষগণের মধ্যে কুবের, বসুগণের মধ্যে অনল ও রুদ্রগণের মধ্যে শিব, পুরােহিতগণের মধ্যে বৃহস্পতি, জলাশয়গণের মধ্যে রত্নাকর, সেনানীর মধ্যে কার্ত্তিক। ২৩-২৪ আমি মহর্ষিগণের মধ্যে ভৃগু, বাক্যের মধ্যে ওঙ্কার | যজ্ঞের মধ্যে জপযজ্ঞ ও স্থাবরের মধ্যে হিমালয়। পর্বত ।২৫ দেবর্ষিগণের মধ্যে আমি নারদ, সিদ্ধগণের মধ্যে কপিল মুনি, গন্ধবর্গণের মধ্যে চিত্ররথ এবং বৃক্ষের মধ্যে অশ্বথ। ২৬
অশ্বে উচ্চৈঃশ্রবা আমি সমুদ্রমন্থনে।
গজ মধ্যে ঐরাবত রাজা নরগণে।।২৭
ধেনুমধ্যে কামধেনু বজ্র আয়ুধেতে ।
সর্পেতে বাসুকি আমি কাম সৃজনেতে ৷ ৷২৮
নাগেতে অনন্ত আমি যাদসে বরুণ ।
পিতৃতে অর্যমা আমি যম সংযমন।।২৯
দৈত্যের প্রহ্লাদ আমি কাল গণনাতে।
পশুতে মৃগেন্দ্র আমি গরুড় পক্ষীতে।।৩০
সরলার্থঃ অশ্বের মধ্যে আমি উচ্চৈঃশ্রবা, গজমধ্যে ঐরাবত এবং নরগণের মধ্যে রাজা। ২৭ আমি ধেনুগণের মধ্যে কামধেনু; অস্ত্রের মধ্যে বজ্র, সর্পের মধ্যে বাসুকি ও সৃষ্টিতে কাম । ২৮ আমি নাগের মধ্যে অনন্ত, জলচরগণের মধ্যে বরুণ, পিতৃগণের মধ্যে অর্যমা ও সংযমনের মধ্যে যম। ২৯ আমি দৈত্যের মধ্যে প্রহ্লাদ; গণনাতে কাল, পশুর মধ্যে সিংহ এবং পাখীর মধ্যে গরুড় ।৩০
বেগগামী মধ্যে বায়ু মকর মীনেতে ।
শাস্ত্রীমধ্যে রাম আমি জাহ্নবী নদীতে।।৩১
আদি অন্ত মধ্য আমি সৃষ্ট সকলের।
বিদ্যা মধ্যে আত্মবিদ্যা বাদ বাদীদের।।৩২
সমাসেতে দ্বন্দ আমি অক্ষরে অ-কার ।
আমিই অক্ষয় কাল বিধাতা সবার।।৩৩
সর্বহারী মৃত্যু আমি ভবিষ্য-উদয় ।
কীর্তি স্মৃতি মেধা ক্ষমা আদি নারীচয়।।৩৪
সরলার্থঃ বেগগামীর মধ্যে আমি বাতাস, মীনের মধ্যে মকর (কুমীর), শাস্ত্রধারীগণের মধ্যে রাম এবং নদীর মধ্যে জাহ্নবী।৩১ আমি সৃষ্টির আদি, অন্ত ও মধ্য, বিদ্যার মধ্যে আত্মবিদ্যা এবং বাদীদের বাদ।৩২ সমাসের মধ্যে আমি দ্বন্দ্ব, অক্ষরের মধ্যে অ-কার, আমি অক্ষয়কাল এবং সকলের বিধাতা ।৩৩ আমি সর্বহারী মৃত্যু। আমি ভবিষ্যৎ সৃষ্টি, কীর্তি স্মৃতি, মেধা ও ক্ষমা প্রভৃতি। ৩৪
সামেতে বৃহৎ সাম গায়ত্রী ছন্দেতে।
মার্গশীর্ষ মাসমধ্যে বসন্ত ঋতুতে।।৩৫
তেজস্বীর তেজ আমি দ্যুত বঞ্চকের।
জয় চেষ্টা সব আমি সত্ত্ব সাত্ত্বিকের।।৩৬
বৃঞ্চিকুলে বাসুদেব, ব্যাস মুনিগণে।
পাণ্ডুকুলে পার্থ আমি শুক্র কবিজনে।।৩৭
জয়েচ্ছুর নীতি আমি দন্ড শাসকের।
গুহামধ্যে মৌন আমি জ্ঞান তত্ত্বজ্ঞের।।৩৮
সরলার্থঃ আমি সামের মধ্যে বৃহৎ সাম, ছন্দের মধ্যে গায়ত্রী, মাসের মধ্যে অগ্রহায়ণ মাস এবং ঋতুর মধ্যে বসন্ত। ৩৫ আমি তেজস্বীর তেজ, বঞ্চকের দূত, জয়ের চেষ্টা এবং সাত্ত্বিকের সত্ত্ব। ৩৬ বৃঞ্চিকুলে আমি বাসুদেব, মুনিদের মধ্যে ব্যাস, পাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুন এবং কবিদের মধ্যে শুক্র। ৩৭ আমি জয়ার্থীর নীতি । শাসকের দণ্ড, গুহা মধ্যে মৌন এবং তত্ত্বজ্ঞানীর জ্ঞান। ৩৮
সর্বভূতে বীজ আমি তােমারে শুধাই ।
আমি ছাড়া চরাচরে আর কিছু নাই।।৩৯
জেনাে পার্থ এ অনন্ত বিভূতি আমার ।
সংক্ষেপে তােমারে আমি কহিলাম সার।।৪০
প্রভাব বিভূতি বল ও শ্ৰীযুত যাহা।
মাের অংশ হতে পার্থ জাত সব তাহা।।৪১
এক অংশে ধরে আছি এ বিশ্ব সংসার।
কি হবে অধিক জেনে পৃথার কুমার।।৪২
সরলার্থঃ আমি ভূতগণের বীজ। এই চরাচরে আমি ছাড়া আর কিছুই নাই ।৩৯ হে অর্জুন, আমার অনন্ত বিভূতি তােমাকে সংক্ষেপে বলিলাম ।৪০ এই বিশ্বে প্রভাব, বিভূতি, বল, শ্রী—সবই আমার অংশ হইতে উৎপন্ন ।৪১ হে অর্জুন, আমি এক অংশ দিয়া বিশ্ব-সংসার ধারণ করিয়া আছি । ইহার অধিক জানিয়া আর কি হইবে?৪২
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দশম অধ্যায়ের সার-সংক্ষেপ
ঈশ্বর বিভূতিময়। তিনি অনাদি। তাঁহার আদিতত্ত্ব দেবতারাও জানেন না। কারণ তিনি দেবতাগণেরও আদি কারণ। যিনি ঈশ্বরকে অনাদি, অজ ও সর্বলােকের মহেশ্বর বলিয়া জানেন, তিনি মােহশূন্য হইয়া সর্বপাপমুক্ত হন। ঈশ্বরের বিভূতির শেষ নাই। তিনি সর্বভূতে আদি অন্ত ও মধ্য। আদিত্য, জ্যোতিষ্ক, নক্ষত্র, দেবতা, রুদ্র, বায়ু– যাহাদের মধ্যে যাহা শ্রেষ্ঠ, ঈশ্বর স্বয়ং তাঁহা। ঈশ্বরের সমস্ত মহিমা বুঝিবার সাধ্য মানুষের নাই। তিনি একাংশে সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া আছেন। ঈশ্বর বুদ্ধিজ্ঞান সুখ-দুঃখ, জন্ম-মৃত্যু, রাগদ্বেষ প্রভৃতি সকল ভাবের ও সকল অবস্থারই মূল কারণ। যিনি ঈশ্বরের বিভূতি বুঝিতে পারেন, তিনি ঈশ্বরের ভক্ত। তাঁহার ভক্তগণ ঈশ্বরগত প্রাণ হইয়া থাকেন। তাঁহারা সর্বদা পরস্পর ঈশ্বরের কথা আলাপ এবং তাঁহার নামকীর্তন করেন । নামকীর্তন শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ। ইহাই উপাসনা । যাঁহারা ঈশ্বরের উপাসনা করেন, ঈশ্বর তাঁহাদিগকে উপযুক্ত জ্ঞান দান করেন। তাঁহারা তাহা দ্বারা ঈশ্বরকে লাভ করেন।
ইতি বিভূতিযােগ নামক দশম অধ্যায়।
আরো পড়ুন:
মঙ্গলাচরণ | প্রথম অধ্যায় | দ্বিতীয় অধ্যায় | তৃতীয় অধ্যায় | চতুর্থ অধ্যায় | পঞ্চম অধ্যায় | ষষ্ঠ অধ্যায় | সপ্তম অধ্যায় | অষ্টম অধ্যায় | নবম অধ্যায় | একাদশ অধ্যায় | দ্বাদশ অধ্যায় | ত্রয়োদশ অধ্যায় | চতুর্দশ অধ্যায় | পঞ্চদশ অধ্যায় | ষােড়শ অধ্যায় | সপ্তদশ অধ্যায় | অষ্টাদশ অধ্যায় | সংক্ষিপ্ত-মাহাত্ম্যম | সম্পূর্ণ-মাহাত্ম্যম | ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র।
0 মন্তব্যসমূহ