চতুর্থ অধ্যায়
জ্ঞানযােগ
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন
জ্ঞানযােগ আমি পূর্বে বলেছি সূর্যেরে।
স্বপুত্র মনুরে সূর্য, মনু ইক্ষাকুরে।।১
পরম্পরাক্রমে ইহা রাজর্ষিরা পায়।
কালবশে ইহা পার্থ নষ্ট হয়ে যায়।।২
ভক্ত মাের সখা মাের, আজ আমি যেই ।
এ পরম গুহ্য যােগ তােমারে জানাই।।৩
সরলার্থঃ এই জ্ঞানযােগ পূর্বে আমি সূর্যকে বলিয়াছিলাম। সূর্য নিজ পুত্র মনুকে বলিয়াছিলেন এবং মনু ইক্ষাকুকে ইহা বলিয়াছিলেন । পরম্পরাক্রমে রাজর্ষিগণও এই জ্ঞান লাভ করিলেন। কালক্রমে ইহা নষ্ট হইয়া গেল।২ হে অর্জুন, জ্ঞানযােগ অত্যন্ত গােপনীয় বিষয়। তুমি আমার ভক্ত ও সখা। সেইজন্যই আমি তােমাকে এই জ্ঞান জানাইতেছি ।৩
অর্জুন কহিলেন
তব পূর্বে জন্মে সূর্য তুমি জন্ম পরে।
কেমনে শিখালে তুমি এ যােগ সূর্যেরে।।৪
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন
বহুবার জন্মিয়াছি তুমি আর আমি।
আমি জ্ঞাত আছি পার্থ ভুলিয়াছ তুমি।।৫
জন্ম মৃত্যু নাই মাের আমি ত ঈশ্বর।
নিজ মায়াবলে ধরি এই কলেরর।।৬
সরলার্থঃ অর্জুন বলিলেন-হে কৃষ্ণ, আগে সূর্যের জন্ম, পরে তােমার জন্ম। তুমি কেমন করিয়া সূর্যকে এই জ্ঞান শিক্ষা দিলে ।৪ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন-হে অর্জুন, তােমার এবং আমার বহুজন্ম অতীত হইয়াছে। আমার মনে আছে কিন্তু সেই সকল তােমার মনে নাই।৫ আমার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই। আমি সর্বভূতের ঈশ্বর। আমি নিজের মায়াবলে শরীর ধারণ করিয়া থাকি ।৬
ধর্মগ্লানি পাপ বৃদ্ধি হইবে যখন।
অবতীর্ণ হই আমি ধরায় তখন।।৭
সাধুত্ৰাণ পাপিনাশ করিতে সাধন।
যুগে যুগে এসে করি ধর্ম সংস্থাপন।।৮
দিব্য জন্মকর্ম মম জানয়ে যে জন।
দেহান্তে আমাকে পায় পুনর্জন্মহীন।।৯
রাগ-ভয়-ক্রোধশূন্য মম পরায়ণ।
মাের ভাব পেয়ে থাকে নিষ্পাপ সে জন।।১০
সরলার্থঃ পৃথিবীতে যখনই ধর্মের গ্লানি হয় এবং পাপ বৃদ্ধি পায়, তখনই আমি শরীর ধারণ করিয়া পৃথিবীতে অবতীর্ণ হই।৭ আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হইয়া সাধুদিগের পরিত্রাণ, পাপিদের বিনাশ এবং ধর্ম সংস্থাপন করি।৮ যে ব্যক্তি আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্মের কথা জানেন সে ব্যক্তি মৃত্যুর পর আমাকে প্রাপ্ত হন। তাঁহার আর পুনর্জন্ম হয় না ।৯ যে ব্যক্তি আসক্তি, ক্রোধ এবং ভয় ত্যাগ করিয়া আমার শরণাপন্ন হয়, তিনি আমার ভাব প্রাপ্ত হন। সেই ব্যক্তির আর বিন্দু মাত্রও পাপ থাকে না ।১০
যেই ভাবে যেই লােক ভজে পার্থ মোরে।
সেই ভাবে সদা আমি ভজাই তাহারে।।১১
দেবতা পূজিয়া পার্থ যেবা সিদ্ধি চায়।
লভে সিদ্ধি সেইজন মুক্তি নাহি পায়।।১২
গুণ কর্ম অনুসারে বর্ণ চতুষ্টয় ।
সৃজিয়াছি, জেনাে মােরে অকর্তা অব্যয়।।১৩
করি কর্ম, লিপ্ত নই, নাহি ফলে স্পৃহা।
কর্ম বন্ধন মুক্ত হয় যারা জানে ইহা।।১৪
সরলার্থঃ হে অর্জুন, যে ব্যক্তি যেভাবে আমার ভজনা করে, সেই ব্যক্তিকে আমি সেই ভাবে তুষ্ট করি ।১১ যে ব্যক্তি দেবতার পূজা করিয়া সিদ্ধি লাভ করিতে চায়, সে তাহা দ্বারাই সিদ্ধিলাভ করে। কিন্তু সেই ব্যক্তি মুক্তি লাভ করিতে পারে না।১২ আমি গুণ ও কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র-এই চারিবর্ণ সৃষ্টি করিয়াছি। কিন্তু আমাকে অকর্তা ও অব্যয় বলিয়াই জানিও।১৩ আমি কর্ম করি কিন্তু আমি কর্মে লিপ্ত হই না। কর্ম ফলেও আমার স্পৃহা নাই। যাহারা ইহা জানে তাহারা কর্ম বন্ধন হইতে মুক্ত হয়।১৪
জানিয়া করিল কর্ম পূর্ব যােগিগণ ।
তুমিও করিবে কর্ম তাঁদেরি মতন।।১৫
কর্ম-অকর্ম ভাবি যােগী কত ভুল করে।
কর্মতত্ত্ব বলি তােমা যাতে দুঃখ হরে।।১৬
কি বা কর্ম কি অকর্ম বিকর্ম কি হয়।
নিগূঢ় কর্মের গতি জানিবে নিশ্চয়।।১৭
কর্মেতে অকর্ম দেখে অকর্মেতে কর্ম।
সেই কর্মী বুদ্ধিমান জানে সর্ব মর্ম।।১৮
সরলার্থঃ পূর্ব যোগিগণ ইহা জানিয়াই কর্ম করিতেন। তুমিও তাঁহাদের মতই কর্ম করিবে।১৫ কর্ম অকর্মের বিচার করিতে গিয়া অনেক কর্মী অনেক ভুল করিয়া থাকে। তাই তােমাকে কর্মতত্ত্ব বলিতেছি।১৬ কর্ম, অকর্ম ও বিকর্ম-কর্মের এই তিন গতি। সে সম্বন্ধে উপদেশ দিতেছি ।১৭ যে ব্যক্তি কর্মে অকর্ম এবং অকর্মে কর্ম দেখে সেই ব্যক্তিই প্রকৃত কর্মী। তিনিই বুদ্ধিমান।১৮
নিষ্কাম হইয়া করে কর্ম সম্পাদন।
জ্ঞানানলে কর্ম দগ্ধ, পণ্ডিত সে জন।।১৯
আত্মতৃপ্ত নিরাশ্রয় ফলাকাঙ্ক্ষা ছাড়ি।
কর্মে রত হয়েও সে নয় কর্মকারী।।২০
নিষ্কাম সংযমী সেই পরিগ্রহ ত্যাগী।
দেহার্থে করেও কর্ম নয় পাপ ভাগী ৷ ৷২১
সন্তুষ্ট সামান্য লাভে ঈর্ষা-দ্বন্দ্ব-হীন।
লাভালাভে তুষ্ট কর্মী নয় কর্মাধীন ৷ ৷২২
সরলার্থঃ যে কর্মী কামনা ত্যাগ করিয়া কর্ম করে জ্ঞান বলে তাহার কর্ম দগ্ধ হয়। সেই কর্মী পণ্ডিত ব্যক্তি।১৯ তিনি আত্মতৃপ্ত ও নিরাশ্রয়। কামনা ছাড়িয়া কর্ম করেন বলিয়া তিনি কর্ম করিয়াও কর্ম করেন না। অর্থাৎ কর্মে লিপ্ত হন না।২০ নিষ্কাম, সংযত ও পরিগ্রহত্যাগী ব্যক্তি দেহরক্ষার জন্য কর্ম করিয়াও পাপভাগী হন না।২১ সামান্য লাভে সন্তুষ্ট, ঈর্ষা দ্বন্দ্বহীন এবং লাভ-অলাভে সমজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি কর্ম করিয়াও কর্মের অধীন হন না।২২
নিষ্কাম নির্মুক্ত জ্ঞানী যজ্ঞে হলে রত ।
সর্বকর্ম লয় পায় ইহা ত নিশ্চিত ৷ ৷২৩
ব্ৰহ্ম অগ্নি, ব্রহ্মহবি, হােম ব্রহ্মময় ।
ব্রহ্মেই তা যায় যদি ব্রহ্মে লক্ষ্য রয়।।২৪
শ্রদ্ধাভরে দৈবযজ্ঞ করে কর্মযােগী ।
ব্রহ্মানলে করে যজ্ঞ জ্ঞানী ফল ত্যাগী ৷ ৷ ২৫
ইন্দ্রিয়কে অর্পে কেহ সংযম অনলে।
কেহবা বিষয় অর্পে ইন্দ্রিয় অনলে।।২৬
সরলার্থঃ নিষ্কাম ও রাগ-দ্বেষাদিবর্জিত জ্ঞানী ব্যক্তি যজ্ঞ (অর্থাৎ ঈশ্বরের সৃষ্টি রক্ষার জন্য কর্ম) করিলেও তাহার সর্বকর্ম লয় পায়।২৩ যে ব্যক্তি অগ্নি, হবিঃ (হােমের দ্রব্য) এবং যজ্ঞ সকলকেই ব্রহ্মময় মনে করেন তাঁহার সমস্তই ব্রহ্মে লয় পায়। ২৪ কর্মযােগী শ্রদ্ধার সহিত দৈবযজ্ঞ করেন। আর ফলত্যাগী জ্ঞানী ব্রহ্মাকেই যজ্ঞ করেন।২৫ কেহ ইন্দ্রিয়গণকে সংযমরূপ অগ্নিতে অর্পণ করে। আর কেহ বিষয়কে ইন্দ্রিয়রূপ অগ্নিতে অর্পণ করে।২৬
জ্ঞানের প্রভাবে আত্ম-সংযম-অনলে।
ইন্দ্ৰয়মনাদি কেহ দহে সুকৌশলে।।২৭
দ্রব্যযজ্ঞ তপােযজ্ঞ যােগযজ্ঞ করে।
স্বাধ্যায় জ্ঞানের যজ্ঞ কেহ বা আচরে।।২৮
প্রাণেতে অপান রুধি অপানেতে প্রাণ।
প্রাণায়ামে করে কেহ ব্ৰহ্ম আরাধন।।২৯
প্রাণে করে প্রাণাহূতি কোন মিতাহারী।
যজ্ঞবিদ সেই জন যজ্ঞে পাপ হরি।।৩০
সরলার্থঃ কেহ বা জ্ঞানের প্রভাবে আত্মসংযমরূপ অগ্নিতে ইন্দ্রিয়, মন প্রভৃতি দগ্ধ করে।২৭ কোন কোন কর্মী দ্রব্যাদি দানরূপ কর্ম করেন, কেহ তপস্যারূপ যজ্ঞ করেন, কেহ যােগ অভ্যাসরূপ যজ্ঞ করেন এবং কেহ বা বেদ পাঠরূপ যজ্ঞ করিয়া থাকেন ।২৮ কেহ প্রাণবায়ুতে অপান বায়ু এবং অপানবায়ুতে প্রাণবায়ু রুদ্ধ করিয়া প্রাণায়াম অভ্যাস করেন এবং তাহা দ্বারাই ব্রহ্মের আরাধনা করেন ।২৯ কোন মিতাহারী ব্যক্তি প্রাণেই প্রাণাহুতি দেন। সেই ব্যক্তি যজ্ঞবিদ। তিনি নিষ্পাপ। ৩০
করিয়া যজ্ঞের শেষ অমৃত ভােজন।
অবশেষে পায় তিনি ব্রহ্ম সনাতন।।৩১
বেদেতে আছয়ে বহু যজ্ঞের বর্ণন।
কর্মজ সে সবে জানি মুক্ত হয় জন।।৩২
দ্রব্যযজ্ঞ হতে পার্থ জ্ঞানযজ্ঞ বড়।
জ্ঞানেতেই কর্ম শেষ জেনাে ধনুর্ধর।।৩৩
প্রণিপাত সেবা আর প্রশ্ন জিজ্ঞাসনে।
উপদেশ দিবে তােমা তত্ত্বজ্ঞানী জনে।।৩৪
সরলার্থঃ যজ্ঞের শেষ অমৃত ভােজন করিয়া সেই যজ্ঞবিদ ব্যক্তি অন্তিমে ব্রহ্মলাভ করেন।৩১ বেদে বহু যজ্ঞের বর্ণনা আছে। সেই সকল যজ্ঞ কর্মজনিত ইহা জানিয়া মুক্ত হওয়া যায়।৩২ হে অর্জুন দ্রব্যযজ্ঞ হইতে জ্ঞানযজ্ঞ বড়। জ্ঞানের দ্বারাই কর্মের শেষ হয়।৩৩ তুমি প্রণাম, সেবা ও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তি তােমাকে জ্ঞান উপদেশ দিবেন।৩৪
লভি জ্ঞান ওহে পার্থ মােহ দূর হবে।
আমাতে ও নিজমধ্যে ভূতাদি দেখিবে।।৩৫
যদি বা হইয়া পড় বেশী পাপাচারী।
পাপসিন্ধু দিবে পাড়ি চড়ি জ্ঞানতরী।।৩৬
জলন্ত অনল পার্থ কাষ্ঠ ভস্ম করে।
জ্ঞানাগ্নিও করে ক্ষয় সকল কর্মেরে।।৩৭
নাহিক পবিত্র কিছু জ্ঞানের সমান।
যথাকালে কর্মযােগী পায় আত্মজ্ঞান।।৩৮
সরলার্থঃ সেই জ্ঞান লাভ করিয়া তােমার মােহ দূর হইবে তখন আমার মধ্যে এবং তােমার নিজের মধ্যেই ভূতগণকে দেখিতে পাইবে ।৩৫ আর তুমি যদি পাপাচারী হইয়া পড়, জ্ঞানতরী আরোহণ করিয়া তুমি পাপসিন্ধু পার হইতে পারিবে ।৩৬ হে অর্জুন, জ্বলন্ত আগুন যেমন কাষ্ঠকে দগ্ধ করে জ্ঞানরূপ আগুনও সেইরূপ সমস্ত কর্ম নষ্ট করে ।৩৭ জ্ঞানের মত পবিত্র আর কিছুই নাই। কর্মযােগী যথাকালে আত্মজ্ঞান লাভ করিয়া থাকেন। ৩৮
শ্রদ্ধাবান ব্রহ্মনিষ্ঠ জিতেন্দ্রিয় জন।
লভি জ্ঞান অচিরেই মােক্ষ প্রাপ্ত হন।।৩৯
শ্রদ্ধাবান সংশয়াত্মা মূর্খ নষ্ট হয়।
ইহলােকে পরলােকে সুখ নাহি পায়।।৪০
যােগেতে অর্পয়ে কর্ম জ্ঞানে ভ্রান্তিহীন ।
সে ব্যক্তি আত্মজ্ঞ হন কর্ম বন্ধহীন ।।৪১
জ্ঞান-অস্ত্রে ছিন্ন করি অজ্ঞান সংশয়।
উঠ পার্থ শীঘ্র কর কর্মযােগাশ্রয়।।৪২
সরলার্থঃ শ্রদ্ধাবান, জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তি জ্ঞানলাভ করিয়া মুক্তি লাভ করেন। ৩৯ যে ব্যক্তি শ্রদ্ধাবান হইয়াও সংশয়মুক্ত হয় না, সে মূর্খ। সে ব্যক্তির ইহলােকে পরলােকে কোথাও সুখ লাভ হয় না। ৪০ যে কর্মী জ্ঞানে ভ্রান্তিহীন হইয়া নিষ্কাম কর্ম করে, সে আত্মজ্ঞ । সে কর্ম করিলেও কর্মে আবদ্ধ হয় না। ৪১ হে অর্জুন, জ্ঞানরূপ অস্ত্রের দ্বারা অজ্ঞানরূপ সন্দেহ দূর কর। কর্মযােগ অর্থাৎ নিষ্কাম কর্ম আশ্রয় কর। তুমি উঠ। ৪২
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের সার-সংক্ষেপ
ঈশ্বরের জন্ম নাই, মৃত্যু নাই। তিনি নিত্য সনাতন তথাপি তিনি নিজের মায়া দ্বারা শরীর গ্রহণ করেন—পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। পৃথিবীতে যখন পাপ বৃদ্ধি পায় ও অধর্মের মাত্রা বাড়িয়া যায়, তখনই তিনি অবতীর্ণ হন। অর্থাৎ অবতার হইয়া পৃথিবীতে আসেন। আসিয়া তিনি দুইটি কাজ করেন। একটি কাজ—দুষ্টের দমন ও সাধুদের রক্ষণ। দ্বিতীয়টি—ধর্ম সংস্থাপন। ভগবানের এই অবতারতত্ত্ব ঠিক বুঝিতে হইবে। বুঝিতে হইবে, মনে রাখিতে হইবে যে, ভগবান অবতাররূপে আসিয়া নিষ্ক্রিয় হইয়াও নির্লিপ্তভাবে কর্ম করেন। ইহা জানিতে পারিলেই লােক ভগবানে আত্মসমর্পণ করিতে পারে এবং নিষ্কাম কর্মের দ্বারা সিদ্ধি লাভ করিতে পারে। তাহার আর অন্য কোন সাধনার প্রয়ােজন হয় না। নানা লােকে নানাভাবে আমার (ঈশ্বরের) ভজনা করে। যে যেভাবে আমার আরাধনা করে, তাহাকে আমি সেভাবেই তুষ্ট করি। যাহারা অন্য দেবতার পূজা করে তাহারাও শেষ পর্যন্ত আমাকেই লাভ করে। আমি গুণ ও কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র-এই চারি বর্ণের সৃষ্টি করিয়াছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি অকর্তা ও বিকাররহিত। পূর্ববর্তী মুক্তিকামী ব্যক্তিগণ এইরূপ কর্ম করিয়া গিয়াছেন । তুমিও সেই আদর্শে নিষ্কামভাবে কর্ম কর ।
কর্মের তিনটি স্বরূপ—কর্ম, অকর্ম ও বিকর্ম। কর্ম মানে বিহিত কর্ম—নিজ কর্তব্য। অকর্ম মানে কর্মত্যাগ। বিকর্ম মানে অপকর্ম । যিনি কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করিয়া কর্ম করেন তাহার কর্মই অকর্ম হয়। যাঁহার কর্তৃত্বাভিমান নাই তিনি অবিহিত কর্ম করিলেও তিনি কর্মের ফলভাগী হন না। এই কর্ম নিষ্কাম কর্ম। নিষ্কাম কর্ম ঈশ্বরের কর্ম। ঈশ্বরের প্রীতির জন্য বা আরাধনার জন্য যে যজ্ঞ সম্পাদন করা হয়, তাহাও বিহিত কর্ম। উহা নিষ্কাম কর্ম। যজ্ঞ অনেক প্রকার-দ্রব্য যজ্ঞ, তপাে যজ্ঞ, যােগ যজ্ঞ, স্বাধ্যায় জ্ঞানযজ্ঞ ইত্যাদি। প্রতি যজ্ঞ ব্রহ্মের উদ্দেশ্যে করা হয়। যজ্ঞ দ্বারা জ্ঞান লাভ হয়। সর্বভূত এবং আমার আত্মা এক–এই বােধই জ্ঞান। জ্ঞানের দ্বারা শােকাদি মােহ দূর হয়, সমস্ত পাপ বিনষ্ট হয়, কর্মবন্ধন থাকে না। গুরুর উপদেশে এই জ্ঞান পাওয়া যায়। তারপর সাধনা অর্থাৎ নিষ্কাম কর্মদ্বারা তাহা আয়ত্ত করিতে হয়। বিশ্বাস ধর্মের মূল । বিশ্বাস জ্ঞানেরও ভিত্তি। বিশ্বাস ছাড়া জ্ঞান লাভ হয় না। বিশ্বাসে শ্রদ্ধা বাড়ে, সংযমে অভ্যাস সহজ হয়। শ্রদ্ধাবান ও জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিই জ্ঞান লাভের অধিকারী । জ্ঞানের বলে সকল সন্দেহ দূর হয়। জ্ঞানযােগী ঈশ্বরের একনিষ্ঠ হইয়া নিষ্কাম কর্ম করিয়া ধন্য হন। তাহার কর্মযােগও সুসম্পন্ন হয় ।
ইতি জ্ঞানযােগ নামক চতুর্থ অধ্যায়।
আরো পড়ুন:
মঙ্গলাচরণ | প্রথম অধ্যায় | দ্বিতীয় অধ্যায় | তৃতীয় অধ্যায় | পঞ্চম অধ্যায় | ষষ্ঠ অধ্যায় | সপ্তম অধ্যায় | অষ্টম অধ্যায় | নবম অধ্যায় | দশম অধ্যায় | একাদশ অধ্যায় | দ্বাদশ অধ্যায় | ত্রয়োদশ অধ্যায় | চতুর্দশ অধ্যায় | পঞ্চদশ অধ্যায় | ষােড়শ অধ্যায় | সপ্তদশ অধ্যায় | অষ্টাদশ অধ্যায় | সংক্ষিপ্ত-মাহাত্ম্যম | সম্পূর্ণ-মাহাত্ম্যম | ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র।
0 মন্তব্যসমূহ