পঞ্চম অধ্যায়
কর্ম সন্ন্যাসযােগ
অর্জুন কহিলেন
কর্মত্যাগ বলি, কর কর্মে উপদেশ ।
শ্রেয়ঃ পথ মােরে কৃষ্ণ কহ সবিশেষ।।১
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন
কর্মত্যাগ কর্মযােগ দুই শুভ হয়।
ত্যাগ হতে যােগ শ্ৰেয় জানিবে নিশ্চয়।।২
ইচ্ছা দ্বেষ নাই যার কর্মযােগী যেই।
সহজে বন্ধনমুক্ত কর্মত্যাগী সেই।।৩
সরলার্থঃ অর্জুন বলিলেন-হে কৃষ্ণ, তুমি কর্মত্যাগ করিতে বলিতেছ, আবার কর্ম করিতেও বলিতেছ। এই দুইটির মধ্যে যেটি আমার পক্ষে মঙ্গলজনক হইবে তাহা বল।১ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন, কর্মত্যাগ ও কর্মযােগ দুইটিই মুক্তিজনক। তবে কর্মত্যাগ অপেক্ষা কর্মযােগই ভাল, অর্থাৎ কর্মত্যাগ করা অপেক্ষা কর্ম করাই ভাল।২ যাঁহার ইচ্ছা দ্বেষ নাই কিন্তু যিনি কর্ম করেন, তিনিই কর্মত্যাগী। তিনি সহজেই বন্ধনমুক্ত হন।৩
জ্ঞান কর্ম নহে এক অজ্ঞানেরা কয়।
একের সাধনে ফল উভয়েরই হয়।।৪
কর্মেতে লভয়ে যাহা তাই লভে জ্ঞানে।
জ্ঞানে কর্মে এক দেখে তত্ত্বদর্শী জনে।।৫
কর্ম ছাড়া জ্ঞান লাভ বড়ই কঠিন।
কর্মযুক্ত মুনি লভে ব্ৰহ্ম সনাতন।।৬
জিতেন্দ্রিয় শুদ্ধচিত্ত আত্মজ্ঞানী জন।
কর্ম করিয়াও কর্মে লিপ্ত নাহি হন ৷ ৷৭
সরলার্থঃ জ্ঞান ও কর্ম এক নয়—ইহা অজ্ঞান ব্যক্তিদের কথা। প্রকৃতপক্ষে একটি দ্বারা দুইটির ফল লাভ করা যায় ।৪ কর্মদ্বারা যা লাভ করা যায়, জ্ঞানেও তা লাভ করা যায় । তত্ত্বদর্শী ব্যক্তি জ্ঞান ও কর্মীকে এক বলিয়াই মনে করে। কর্ম না করিলে জ্ঞান লাভ করা যায় না। কর্মী কর্ম করিয়াই ঈশ্বরকে লাভ করিয়া থাকে ।৬ জিতেন্দ্রিয়, শুদ্ধচিত্ত, আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি কর্ম করেন, কিন্তু কর্মে লিপ্ত হন না।৭
আমি করি” এই ভাব নাই জ্ঞানী মনে।
দর্শন, শ্রবণ স্পর্শ ভােজনে গমনে।। ৮
উন্মেষাদি সর্ব কর্মে জ্ঞানী জানে সার।
এসব ইন্দ্রিয়-কার্য নয় আপনার।।৯
যে জন করয়ে কর্ম ব্রহ্মে সপি ফল ।
নির্লিপ্ত নিষ্পাপ যথা পদ্ম পত্রে জল।।১০
ফলত্যাগী কর্মযােগী সদা কর্ম করে।
মনাদি ইন্দ্রিয়দ্বারা আত্মশুদ্ধি তরে।।১১
সরলার্থঃ “আমি কর্ম করি”- এই কথা কর্মযােগে যুক্ত তত্ত্বদর্শী জ্ঞানী ব্যক্তি ভাবেন না ।৮ জ্ঞানী ব্যক্তি উন্মেষ নিমেষ প্রভৃতি সমস্ত কর্মই ইন্দ্রিয়ের কাজ বলিয়া মনে করেন। তাঁহার কর্তৃত্বাভিমান নাই ।১ যিনি ফলাকাঙ্ক্ষা ঈশ্বরে অপর্ণ করিয়া কর্ম করেন, তিনি নির্লিপ্ত ও নিষ্পাপ হন।১০ ফলত্যাগী কর্মযােগী মন আদি ইন্দ্রিয়দ্বারা আত্মশুদ্ধি লাভ করার জন্যই কর্ম করেন।১১
ফলত্যাগী কর্মযােগী নিষ্ঠা, শান্তি পায়।
ফলাসক্ত কর্মী কিন্তু বন্ধনেতে রয়।।১২
নবদ্বারদেহপুরে যোগী বাস করে।
না করে নিজে কর্ম না করায় অন্যেরে।।১৩
জীবের কর্তৃত্ব কর্ম কর্মফল যত।
প্রভু নাহি সৃজে তাহা স্বভাবত জাত।।১৪
পাপ পুণ্য কারাে কভু বিভু নাহি লন।
অজ্ঞানে আবৃত তাই ভ্রান্ত জীবগণ।।১৫
সরলার্থঃ ফলত্যাগী কর্মযােগী প্রকৃত শান্তিলাভ করেন। ফলাসক্ত কর্মী বদ্ধ হয়।১২ ফলত্যাগী কর্মী-নবদ্বারযুক্ত দেহে বাস করেন। তিনি নিজেও কর্ম করেন না, অন্যকে দিয়াও করান না।১৩
টীকাঃ নবদ্বার দেহপুরে–দুই চক্ষু, দুই কান, দুই নাক, মুখ, পায়ু ও উপস্থ দেহের এই নয়টি দ্বার।
কর্মযােগী জিতেন্দ্রিয়। তাই তিনি ইন্দ্রিয়যুক্ত শরীর ধারণ করিয়াও নির্লিপ্ত অবস্থায় থাকেন। প্রকৃতি মানুষকে প্রবৃত্ত করে। ঈশ্বর (বা আত্মা) কর্ম, কর্তৃত্ব বা কর্মফল কিছুই সৃষ্টি করেন না।১৪ ঈশ্বর কাহারও পাপ-পুণ্য গ্রহণ করেন না। অজ্ঞানতা দ্বারা জ্ঞান আচ্ছন্ন থাকে। তাই জীব মােহগ্রস্ত হয়। ১৫
আত্মজ্ঞানে সে অজ্ঞান দূর হয় যার।
সূর্যসম পরতত্ত্ব প্রকাশয়ে তার।।১৬
তাহে নিষ্ঠা থাকে যার দেহ-প্রাণ-মন ।
জ্ঞান-ধৌত পাপ থেকে মুক্ত সেইজন।।১৭
ব্রাহ্মণে চন্ডালে গজে গুরুতে কুকুরে।
বিদ্যানম্র পণ্ডিতেরা সমজ্ঞান করে।।১৮
সমজ্ঞানী যোগী জিনে সংসার নিশ্চয়।
নির্দোষ ব্রহ্মেরে জানি ব্রহ্মভাব হয় ৷ ৷১৯
ব্রহ্মে থাকি ব্রহ্মে জানি স্থিরবুদ্ধি জন।
ইষ্টে তুষ্ট বা অনিষ্টে রুষ্ট কভু নন।।২০
সরলার্থঃ আত্মজ্ঞানের দ্বারা যাহার অজ্ঞান দূর হয়, সেই ব্যক্তিই পরমতত্ত্ব জানিতে পারে ।১৬ যাহার মনপ্রাণ আত্মজ্ঞানে নিষ্পাপ সেই ব্যক্তি মুক্ত।১৭ আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি ব্রাহ্মণে-চণ্ডালে, হাতীতে-কুকুরে সমান জ্ঞান করেন।১৮ সমজ্ঞানী ব্যক্তি সংসার জয় করিয়া থাকেন, ব্রহ্মকে জানিয়া তিনি ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন।১৯ ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তি কখনও ইষ্টে তুষ্ট বা অনিষ্টে রুষ্ট হন না।২০
ইন্দ্রিয় বিষয়ে নিত্য অনাসক্ত মন।
অন্তিমে অনন্ত সুখে সুখী তিনি হন।।২১
বিষয় ভােগেতে সুখ দুঃখের কারণ।
অনিত্য জানিয়া জ্ঞানী তৃপ্ত নাহি হন।।২২
কাম-ক্রোধ বেগ যেই নহে আমরণ ।
‘সদা সুখে রহে সেই মুক্তযােগী জন।।২৩
অন্তরেতে সুখী সেই আত্মদৃষ্টিময়।
ব্রহ্মেতে নির্বাণ তার হয় সুনিশ্চয়।।২৪
সরলার্থঃ ব্রহ্মজ্ঞানীর মন ইন্দ্রিয়বিষয়ে অনাসক্ত। মৃত্যুর পর তিনি অনন্ত সুখ লাভ করেন।২১ বিষয় ভােগে যে সুখ হয় তাহা অনিত্য ও দুঃখের কারণ । জ্ঞানী ব্যক্তি বিষয় সুখে তৃপ্ত থাকেন না।২২ যিনি জিতেন্দ্রিয় তিনি মুক্তযােগী। তিনি সর্বদা সুখে থাকেন।২৩ আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি অন্তরে সুখী হয়। তিনি ব্রহ্মে নির্বাণ লাভ করিয়া থাকেন।২৪
ক্ষীণপাপ দ্বিধাহীন সর্বহিতে রত ।
চিত্তজয়ী সেই মুনি মুক্ত অবিরত।।২৫
সর্বহিতে চিত্ত যার সদা বশীভূত।
ইহ-পরলােকে পায় নির্বাণ নিশ্চিত ৷ ৷২৬
দূর করি বাহ্য চিন্তা দৃষ্টি স্থাপি ভ্রুতে ।
সম করি প্রাণপণ চাপি নাসা পথে ৷ ৷২৭
জিতেন্দ্রিয় মন বুদ্ধি ইচ্ছাশূন্য যিনি ।
মােক্ষে লক্ষ্য নিরন্তর সদা মুক্ত তিনি।।২৮
যজ্ঞেশ্বর যােগেশ্বর আমি মহেশ্বর।
জীব-বন্ধু জানি মােরে শান্তি লভে নর।।২৯
সরলার্থঃ জিতেন্দ্রিয় কর্মযােগী নিষ্পাপ, দ্বিধাহীন ও সকলের হিতসাধনে রত থাকেন। তিনি সর্বদাই মুক্ত।২৫ জিতেন্দ্রিয় আত্মজ্ঞানী ব্যক্তি নির্বাণ লাভ করিয়া থাকেন।২৬ জিতেন্দ্রিয় আত্মজ্ঞানী বাহ্য চিন্তা দূর করিয়া ভ্রুমধ্যে দৃষ্টিস্থাপন করতঃ প্রাণায়ামের দ্বারা মােক্ষলাভের জন্য নিবিষ্ট হন।২৭-২৮ হে অর্জুন, আমি যজ্ঞেশ্বর, আমি যােগেশ্বর, আমিই মহান ঈশ্বর । আমি জীবের বন্ধু । ইহা জানিয়া জীব শান্তি লাভ করে।২৯
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পঞ্চম অধ্যায়ের সার-সংক্ষেপ
পঞ্চম অধ্যায়ের আলােচ্য বিষয় হইতেছে– কর্মত্যাগ ও কর্মযােগ এই দুইটির কোনটি শ্রেয়স্কর। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মতে, কর্মত্যাগ করা অপেক্ষা কর্ম করা ভাল। কারণ কর্মত্যাগ ব্রহ্মজ্ঞানীর জন্য, আর কর্ম কর্মযােগীর জন্য । উভয়েরই এক ফল । কর্ম বন্ধনের কারণ নয়। আসক্তি বন্ধনের কারণ। তাই কর্মত্যাগ কর্ম না করা নয়। ফলের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করা, নিষ্কাম কর্ম করাই কর্ম ত্যাগ করা। ইহাই কর্মযােগ ।
ইতি কর্ম সন্ন্যাসযােগ নামক পঞ্চম অধ্যায়।
আরো পড়ুন:
মঙ্গলাচরণ | প্রথম অধ্যায় | দ্বিতীয় অধ্যায় | তৃতীয় অধ্যায় | চতুর্থ অধ্যায় | ষষ্ঠ অধ্যায় | সপ্তম অধ্যায় | অষ্টম অধ্যায় | নবম অধ্যায় | দশম অধ্যায় | একাদশ অধ্যায় | দ্বাদশ অধ্যায় | ত্রয়োদশ অধ্যায় | চতুর্দশ অধ্যায় | পঞ্চদশ অধ্যায় | ষােড়শ অধ্যায় | সপ্তদশ অধ্যায় | অষ্টাদশ অধ্যায় | সংক্ষিপ্ত-মাহাত্ম্যম | সম্পূর্ণ-মাহাত্ম্যম | ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র।
0 মন্তব্যসমূহ