Chapter-1 বাংলায় শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার প্রথম অধ্যায় | First Chapter of Srimad Bhagavad Gita in Bengali

Chapter-1 বাংলায় শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার প্রথম অধ্যায় | First Chapter of Srimad Bhagavad Gita in Bengali


প্রথম অধ্যায় 


অর্জুন বিষাদযােগ


ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন

ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে চলিল যে রণ।

কি করিল মাের পুত্র পাণ্ডু পুত্রগণ।।১

সরলার্থঃ ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, হে সঞ্জয় ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে আমার পুত্রগণ ও পাণ্ডুর পুত্রগণ যুদ্ধের জন্য সমবেত হইয়া কি করিলেন? ১

টীকাঃ কুরুক্ষেত্ৰ-ইহা ছিল দেবতাদের যজ্ঞস্থান। দ্বাপরযুগে কুরু নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি এই স্থানে তপস্যা করিয়া বর লাভ করিয়াছিলেন। তারপর হইতে এই স্থানের নাম হইল কুরুক্ষেত্র। 

ধর্মক্ষেত্রঃ কুরুক্ষেত্র শ্রেষ্ঠ তীর্থস্থান। এইজন্যই ইহা ধর্মক্ষেত্র।


সঞ্জয় কহিলেন

পাণ্ডবের সৈন্যব্যুহ দেখিয়া রাজন।

আচার্য, সমীপে গিয়া কন দুর্যোধন।।২

আচার্য, দেখুন ব্যুহ পাণ্ডব-সেনার।

রচেছে দ্রুপদ-পুত্র শিষ্য আপনার।।৩

হেথা আছে বীর সব ভীমার্জুন মত।

সাত্যকি বিরাট আর দ্রুপদাদি যত।।৪

ধৃষ্টকেতু কাশীরাজ আর চেকিতান।

পুরুজিৎ কুন্তিভােজ শৈব্য বীর্যবান।।৫

সরলার্থঃ সঞ্জয় বলিলেন-তখন রাজা দুর্যোধন পাণ্ডব সৈন্যদিগকে ব্যূহাকারে সজ্জিত দেখিয়া দ্রোণাচার্যের নিকট গিয়া বলিলেন। ২ গুরুদেব, আপনার ধীমান শিষ্য দ্রুপদপুত্র কর্তৃক ব্যূহবদ্ধ পাণ্ডবদিগের এই বিশাল সৈন্যদল দেখুন ।৩ এই সৈন্যদলে ভীমার্জুনের সমান বীরগণ আছেন সাত্যকি, বিরাট ও বীর দ্রুপদ আছেন।৪ এই সৈন্যদলে ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, বীর কাশীরাজ, কুন্তিভােজ পুরুজিৎ ও নরশ্রেষ্ঠ শৈব্য আছেন ।৫


যুধামন্যু উত্তমৌজা অভিমন্যু বীর ।

মহাবলশালী যত পুত্র দ্রৌপদীর।।৬

আমাদের পক্ষে যারা মহাধনুর্ধর।

শুনুন তাঁদের নাম বলি দ্বিজবর ৷ ৷৭

আপনিও ভীষ্ম রণজয়ী কৃপ কর্ণ।

অশ্বত্থামা সােমদত্ত তনয় বিকর্ণ ৷ ৷৮

সরলার্থঃ আর আছেন পরাক্রমশালী যুধামুন্য। বীর উত্তমৌজা, সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পুত্রগণ । ইহারা সকলেই বীর ।৬ 

টীকাঃ কুন্তিভােজ পুরুজিৎ—তিনি পাণ্ডবদের মাতুল। ধৃষ্টকেতু-শিশুপালের পুত্র।

হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আমার সৈন্যদলের প্রধান সেনানায়কদের নাম বলিতেছি শুনুন ।৭ এখানে আপনি, ভীষ্ম, কর্ণ, যুদ্ধজয়ী কৃপ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সােমদত্ত পুত্র ও জয়দ্রথ আছেন।৮


অস্ত্রধারী মহাযােদ্ধা আরাে অগণন ।

মাের তরে প্রাণ দিতে সবে আগুয়ান ।। ৯

ভীষ্মের রক্ষিত সৈন্য বড়ই পর্যাপ্ত।

ভীমের রক্ষিত সৈন্য হের অপর্যাপ্ত।। ১০

ব্যূহপথে নিজস্থানে থাকি বীরগণ ।

রক্ষিবেন পিতামহে হয়ে সাবধান।। ১১

দুর্যোধনে হরষিতে ভীষ্ম মহাবীরে ।

সিংহনাদ সহ তদা শঙ্খধ্বনি করে ৷ ৷১২

সরলার্থঃ আরও অনেক বীর আছেন। তাঁহারা সকলেই অস্ত্রধারী বীর ও যুদ্ধে পারদর্শী। সকলেই আমার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত। ৯ ভীষ্মকর্তৃক রক্ষিত আমাদের সৈন্য অসংখ্য। আর ভীমকর্তৃক রক্ষিত পাণ্ডবদের সৈন্য অতি অল্প ।১০ আপনারা সকলে নিজ নিজ বিভাগানুসারে ব্যূহ-প্রবেশ পথসমূহে থাকিয়া ভীষ্মকে রক্ষা করুন।১১ তখন কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম সিংহনাদ করিয়া শঙ্খধ্বনি করিলেন। তাহা শুনিয়া দুর্যোধন আনন্দিত হইলেন। ১২


বাজিয়া উঠিল শখ শিঙ্গা ঢাক-ঢােল।

উঠিল তুমুল শব্দ নাগরার রােল।।১৩

বসিয়া শ্বেতাশ্ব রথে কৃষ্ণ ধনঞ্জয়।

বীরদর্পে বাজাইলা দিব্য শঙ্খদ্বয় ।।১৪

‘দেবদত্ত’ নামে পার্থ কৃষ্ণ ‘পাঞ্চজন্য।

ভীমসেন বাজাইলা ‘পৌন্ড্র’ নামে অন্য ৷ ৷১৫

‘অনন্ত বিজয়’ শঙ্খ ধরে যুধিষ্ঠির।

‘সুঘােষ’ ও ‘মণিপুষ্প’ দু’পুত্র মাদ্রীর ৷ ৷১৬

সরলার্থঃ তখন শঙ্খ, শিঙ্গা, ঢাক, ঢােল ও নাগরা বাজিল । সেই শব্দ তুমুল হইয়া উঠিল।১৩ তারপর শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন সাদা ঘােড়ার রথে বসিয়া দিব্য শঙ্খ বাজাইলেন।১৪ অর্জুন ‘দেবদত্ত’ নামক শঙ্খ ও শ্রীকৃষ্ণ ‘পাঞ্চজন্য’ নামক শঙ্খ এবং ভীমসেন ‘পৌন্ড্র’ নামক শঙ্খ বাজাইলেন ।১৫ রাজা যুধিষ্ঠির ‘অনন্তবিজয়’ নামক শঙ্খ, নকুল ‘সুঘােষ’ নামক শঙ্খ এবং সহদেব ‘মণিপুষ্প’ নামক শঙ্খ বাজাইলেন।১৬


ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী ও কাশীর সম্রাট।

আর যত ধনুর্ধর সাত্যকি বিরাট ৷ ৷১৭

মহাযােদ্ধা অভিমন্যু আর বীরগণ।

নিজ নিজ শঙ্খ তাঁরা ধ্বনিল তখন ৷ ৷১৮

সেই রােল স্বর্গ-মর্ত্যে তুমুল ধ্বনিয়া।

করিল বিদীর্ণ যত কৌরবের হিয়া।।১৯

কৌরবেরা সমুদ্যত অস্ত্র ছাড়িবারে।

হেরি’ পার্থ তুলি’ ধনু বলিলা কৃষ্ণেরে।।২০

সরলার্থঃ ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, কাশীরাজ, সাত্যকি ও বিরাট নিজ নিজ শঙ্খ বাজাইলেন।১৭ মহাযােদ্ধা অভিমন্যু এবং অন্যান্য বীরগণও নিজ নিজ শঙ্খ বাজাইলেন।১৮ সেই তুমুল শব্দে কৌরবদের প্রাণ বিদীর্ণ করিতে লাগিল।১৯ কৌরবগণকে যুদ্ধের জন্য উদ্যত দেখিয়া অর্জুন ধনু তুলিয়া শ্রীকৃষ্ণকে বলিলেন।২০


অর্জুন কহিলেন 

শুন কৃষ্ণ তব প্রতি কহিনু বচন।

সেনাদ্বয় মাঝে রথ কর সংস্থাপন।।২১

দেখে লই কে কে আজ অবস্থিত রণে ।

করিতে হইবে যুদ্ধ কাহাদের সনে।।২২

দেখিব কাহারা এই যুদ্ধ ইচ্ছা করে।

দুষ্টমতি দুর্যোধনে প্রিয় সাধিবারে।।২৩

সঞ্জয় কহিলেন 

হৃষীকেশ শুনিলেন অর্জুন বচন।

যথাস্থানে রাখি রথ, অর্জুনেরে কন।। ২৪

সরলার্থঃ অর্জুন বলিলেন— উভয় পক্ষের সেনার মধ্যে আমার রথ স্থাপন কর। ২১ কাহাদের সহিত আমাকে যুদ্ধ করিতে হইবে তাহা দেখিয়া লই।২২ আর যাহারা দুষ্টমতি দুর্যোধনের মঙ্গল সাধন করিতে আসিয়াছে তাহাদিগকে দেখিব।২৩ সঞ্জয় বলিলেন— অর্জুনের কথা শুনিয়া শ্রীকৃষ্ণ উভয় সেনার মধ্যে রথ স্থাপিত করিয়া অর্জুনকে বলিলেন ।২৪


দেখ পার্থ নিরখিয়া দেখ এইক্ষণ।

ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ আদি কুরুযোদ্ধাগণ।।২৫

গুরুজন সহােদর আর পিতামহ।

মাতুল শ্বশুর মিত্র পুত্রপৌত্রসহ।।২৬

বিপক্ষে হেরিয়া সব আত্মীয়-স্বজন।

দয়াযুক্ত মনে পার্থ বলেন বচন।।২৭

অর্জুন কহিলেন যুদ্ধার্থী হেরিয়া কৃষ্ণ, আত্মীয় সকল ।

বিশুষ্ক বদন মাের শরীর বিকল।।২৮

সরলার্থঃ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন—হে অর্জুন, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ প্রভৃতি কুরুপক্ষীয় যােদ্ধাগণকে চাহিয়া দেখ ।২৫ অর্জুন গুরুজন, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর এবং বন্ধুগণকে দেখিলেন। ২৬ তাঁহাদের সকলকে বিপক্ষে দেখিয়া দয়াযুক্ত হইয়া দুঃখিত মনে শ্রীকৃষ্ণকে বলিলেন।২৭ অর্জুন বলিলেন-হে কৃষ্ণ, আত্মীয়গণকে বিপক্ষে যুদ্ধের জন্য উপস্থিত দেখিয়া আমার মুখ শুকাইয়া গিয়াছে ও শরীর বিকল হইয়াছে ।২৮


কাঁপিছে শরীর দেহ রােমহর্ষ হয়।

হাত হতে খসে ধনু গাত্র জ্বালাময়।।২৯

স্থির রতে নাহি পারি, ঘােরে যেন মন।

দেখি বিপরীত কৃষ্ণ সকল লক্ষণ।৩০

মারিয়া স্বজনগণে শ্রেয়ঃ নাহি রণে।

চাহি না বিজয় কৃষ্ণ রাজ্য সুখ-ধনে ।।৩১

কি হবে গােবিন্দ বল রাজ্য ভােগ-প্রাণে।

যাদের কারণে ইহা করি আকিঞ্চনে।।৩২

সরলার্থঃ আমার শরীর কাঁপিতেছে ও রােমহর্ষ হইতেছে। আমার হাত হইতে ধনু খসিয়া পড়িতেছে গা জ্বলিতেছে।২৯ হে কৃষ্ণ, আমার মাথা ঘুরিতেছে। আমি সব বিপরীত লক্ষণ দেখিতেছি ।৩০ আত্মীয়গণকে মারিয়া মঙ্গল হইবে না। হে কৃষ্ণ, আমি এই যুদ্ধে জয় চাই না এবং ধন, রাজ্য-সুখও চাই না । ৩১ হে মাধব, যাহাদের জন্য এই রাজ্য ভােগ এবং প্রাণ, সেই আত্মীয়গণকে মারিয়া কি হইবে বল আমায়। ৩২


সেই গুরু পিতামহ পুত্রাদি স্বজন।

উপস্থিত দিতে রণে প্রাণ বিসর্জন।।৩৩

মাতুল শ্বশুর পৌত্র শ্যালকাদি যত ।

হত হই, পারিব না করিতে নিহত ।।৩৪

ত্রিভুবন লভিলেও কি হইবে ফল।

ধার্তরাষ্ট্রগণে বধি, কোথা শান্তি বল।।৩৫

আততায়ী বটে ওরা তবু ত বান্ধব।

জ্ঞাতি বধি সুখী কভু হব কি মাধব।।৩৬

সরলার্থঃ গুরু, পিতামহ ভীষ্ম ও আত্মীয়গণ সকলে যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিতে উপস্থিত হইয়াছেন ।৩৩ মাতুল, শ্বশুর, শ্যালকাদি সকলে প্রাণ দিতে আসিয়াছেন। তাঁহারা আমাদের মারুক আপত্তি নাই, কিন্তু আমি তাঁহাদিগকে মারিতে পারিব না ।৩৪ তাঁহাদিগকে বধ করিয়া ত্রিভুবন লাভ করিলেও কোন ফল হইবে না ।৩৫ কৌরবগণকে বধ করিয়া বিন্দুমাত্র শান্তি হইবে না। আততায়ী হইলেও তাঁহারা আপনজন জ্ঞাতি। হে কৃষ্ণ, জ্ঞাতিগণকে বধ করিয়া আমি সুখী হইতে পারিব কি? ৩৬


লােভে অভিভূত ওরা করে না চিন্তন।

মিত্রদ্রোহে কুলক্ষয়ে পাপ যে ভীষণ।।৩৭

আমরা ত জানি এই কুলক্ষয়ী রণ।

বিরত কেন না হব বল জনার্দন ।।৩৮

কুলক্ষয় হলে হয় কুলধর্ম নাশ।

কুলধর্ম নাশে পায় অধর্ম প্রকাশ।।৩৯

অধর্ম প্রভাবে কুলনারী ভ্ৰষ্টা হয়।

ভ্ৰষ্টা নারী হতে বর্ণসঙ্কর উদয়।।৪০

সরলার্থঃ লােভের বশে তাঁহারা হিতাহিত চিন্তা করিতে পারিতেছেন না। আপনজনের সহিত বিবাদে কুলক্ষয় হয়। কুলক্ষয় হইলে ভীষণ পাপ হয় ।৩৭ হে কৃষ্ণ, আমরাও ত জানি যে, এই যুদ্ধে বংশনাশেরই সম্ভাবনা। তবে এই যুদ্ধে বিরত হইব না কেন? ৩৮ বংশ নষ্ট হইলে কুলধর্ম নষ্ট হয়। কুলধর্ম নষ্ট হইলে অধর্ম ঘটে।৩৯ অধর্ম ঘটিলে কুলনারীগণ চরিত্রহীন হয়। কুলনারীগণ চরিত্রহীন হইলে বর্ণসঙ্কর জন্মে ।৪০


ইহাতে নরকে যায় কুলঘ্ন ও কুল।

পিতারা পতিত হয় বিনা পিন্ডজল।।৪১

এই দোষে কুলহন্তা সঙ্কর কারণ।

কুলধর্ম জাতিধর্ম তাতে উৎসাদন।।৪২

কুলধর্ম নষ্ট করে নরকেতে বাস।

হেন বাক্য শুনি কৃষ্ণ শাস্ত্রেতে প্রকাশ।।৪৩

টীকাঃ বর্ণসঙ্কর-বিভিন্ন বর্ণের স্ত্রী-পুরুষের সংযােগে সন্তান উৎপত্তি।

সরলার্থঃ বর্ণসঙ্করের জন্য কুলনাশকারীরা ও কুল নরকে যায়। জলপিণ্ডের অভাবে পিতৃপুরুষ নরকে পতিত হন।৪১ বর্ণসঙ্কর জন্মিলে কুলধর্ম ও জাতিধর্ম নষ্ট হয়।৪২ কুলধর্ম নষ্ট হইলে নরকে বাস হয়। হে কৃষ্ণ, ইহা তাে শাস্ত্রের বচন ।৪৩


রাজ্য সুখ লােভে মােরা মহাপাপে রত।

বধিতে স্বজনগণে হয়েছি উদ্যত।।৪৪

অশস্ত্র আমায় যদি বধে কুরুগণ।

তাতেও পরম শ্রেয়ঃ শুন জনার্দন।।৪৫

সঞ্জয় কহিলেন এত বলি ধনঞ্জয় বিষাদ অন্তর।

ধনুক ছাড়িয়া বসে রথের উপর।।৪৬

সরলার্থঃ রাজ্য ও সুখভােগের লােভে আমরা মহাপাপ করিতে বসিয়াছি ।৪৪ হে কৃষ্ণ, কৌরবগণ যদি অস্ত্রহীন আমাকে বধও করে তাহাও মঙ্গলের কারণ হইবে।৪৫ সঞ্জয় বলিলেন-শােকাকুল অর্জুন এই কথা বলিয়া ধনুর্বাণ ত্যাগ করিয়া রথের উপর বসিয়া পড়িলেন।৪৬


শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার প্রথম অধ্যায়ের সার-সংক্ষেপ

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কৌরব-সৈন্য ও পাণ্ডবসৈন্য মুখোমুখি দাঁড়াইয়া যুদ্ধ শুরু হইবে। এমন সময় পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ করিতে আসিলেন মধ্যম পাণ্ডব অর্জুন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সারথি। অর্জুন বলিলেন, “হে কৃষ্ণ উভয় সৈন্যদলের মধ্যস্থলে আমার রথ স্থাপিত কর। কে কে আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছে তাহা একবার দেখিব।” শ্রীকৃষ্ণ উভয় সৈন্যদলের মধ্যে রথ স্থাপিত করিয়া বলিলেন- “হে অর্জুন, বিপক্ষীয় সৈন্যদল দেখিয়া লও।” অর্জুন চাহিয়া দেখিলেন। বিপক্ষীয় সৈন্যদলে আছেন— আচার্য দ্রোণ, পিতামহ ভীষ্ম, কর্ণ, অশ্বথামা প্রমুখ বীরগণ এবং আত্মীয়স্বজনগণ সকলেই অর্জুনের বিপক্ষে যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত দেখিয়া অর্জুনের ভাবান্তর হইল । তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বলিলেন- “হে কৃষ্ণ, গুরুজন ও আত্মীয়স্বজন সকলে আমার সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়াছে। এ যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে গুরুজনদিগকে বধ করিতে হইবে। আত্মীয় স্বজনগণকে বিনাশ করিতে হইবে। স্বজনগণকে বধ করিলে বংশ নাশ হইবে। বংশনাশ হইলে কুলনারীগণ ভ্রষ্টা হইবে। তাহাতে কুলধর্ম নষ্ট হইবে, বর্ণসঙ্কর জনিবে। বর্ণসঙ্কর নরকভােগের কারণ হইবে। জলপিণ্ডের অভাবে পিতৃপুরুষ নরকে যাইবেন।


দ্বিতীয়ত, রাজ্যলাভ ও সুখভােগের আশায়ই ত এই যুদ্ধ। যাহাদের জীবনপাতে যুদ্ধে জয় হইবে তাহারা যে আমারই আপনজন। আপনজনদের রক্তপাত করিয়া যে জয় ও রাজ্যলাভ হইবে তাহাতে সত্যিকারের সুখ হইবে কি ? ইহাতে হইবে ঘাের পাপ ও অশেষ ক্ষতি। হায়! লােভের বশবর্তী হইয়া আমি কি পাপ কাজই না করিতে উদ্যত হইয়াছি। “এই পাপের পরিণাম কতই না ভয়াবহ হইবে। ভাবিয়া ভাবিয়া আমার মুখ শুকাইয়া গিয়াছে, শরীর কাঁপিতেছে, হাত হইতে ধনুর্বাণ খসিয়া পড়িতেছে। আমি আর স্থির থাকিতে পারিতেছি না। আমি যুদ্ধ করিব না কৃষ্ণ।” এই কথা বলিয়াই অর্জুন ধনুর্বাণ ত্যাগ করিয়া বিষন্ন বদনে রথের উপর বসিয়া পড়িলেন। অর্জুনের এই দুঃখই গীতার বিষাদ-যােগ। ইহা হইতে গীতার উদ্ভব । 


পরবর্তী অধ্যায়সমূহে আমরা দেখিব যে শ্রীকৃষ্ণ কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির উপদেশ দ্বারা অর্জুনের বিষাদ দূর করিলেন। অর্জুন প্রবুদ্ধ হইলেন। প্রবুদ্ধ হইয়া তিনি স্বীয় কর্তব্য সম্পাদনে কৃতসংকল্প হইলেন ।

ইতি বিষাদযােগ নামক প্রথম অধ্যায়।


আরো পড়ুন:

মঙ্গলাচরণ | দ্বিতীয় অধ্যায় | তৃতীয় অধ্যায় | চতুর্থ অধ্যায় | পঞ্চম অধ্যায় | ষষ্ঠ অধ্যায় | সপ্তম অধ্যায় | অষ্টম অধ্যায় | নবম অধ্যায় | দশম অধ্যায় | একাদশ অধ্যায় | দ্বাদশ অধ্যায় | ত্রয়োদশ অধ্যায় | চতুর্দশ অধ্যায় | পঞ্চদশ অধ্যায় | ষােড়শ অধ্যায় | সপ্তদশ অধ্যায় | অষ্টাদশ অধ্যায় | সংক্ষিপ্ত-মাহাত্ম্যম | সম্পূর্ণ-মাহাত্ম্যম | ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ