অষ্টাদশ অধ্যায়
মােক্ষযােগ
অর্জুন কহিলেন
সন্ন্যাসের তত্ত্ব বল দেবকী নন্দন।
ত্যাগ অর্থে কি বুঝায় কহ নারায়ণ।।১
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন
কাম্য কর্ম ত্যাগ হয় সন্ন্যাস সংসারে।
সর্ব কর্ম ফলত্যাগ ত্যাগ নাম ধরে।।২
কর্ম মাত্র দোষযুক্ত, ত্যাজ্য কেহ কয় ।
কেহ মর্তে কর্ম কিন্তু কভু ত্যাজ্য নয়।।৩
সরলার্থঃ হে কৃষ্ণ, ‘সন্ন্যাস’ ও ‘ত্যাগ’ বলিতে কি বুঝায় তাহা আমাকে বল। ১ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন-হে অর্জুন, কাম্য-কর্ম ত্যাগকে সন্ন্যাস বলে । আর সর্বকর্মফল ত্যাগকে ‘ত্যাগ’ বলে। কেহ কেহ বলেন— কাম্য কর্ম মাত্রই দোষের অতএব, তাহা পরিত্যাজ্য। আবার কেহ কেহ বলেন- কাম্যকর্ম ত্যাজ্য নয়। ৩
ত্রিবিধ হয় যে ত্যাগ শুন ধনঞ্জয়।।৪
যজ্ঞ দান তপ কার্য কভু ত্যাজ্য নয়।
ইহাদের অনুষ্ঠানে চিত্ত শুদ্ধ হয়।।৫
ফলাশা ছাড়িয়া পার্থ কর্ম যে করিবে।
ইহাই উত্তম মত স্মরণে রাখিবে।।৬
যার যা নিয়ত কর্ম কভু ত্যাজ্য নয়।
মােহেতে করিলে ত্যাগ তামসিক হয়।।৭
সরলার্থঃ হে অর্জুন, তােমাকে ত্যাগ সম্বন্ধে বলিতেছি। ত্যাগ তিন প্রকার। ৪ যজ্ঞ, দান ও তপস্যা প্রভৃতি কর্ম কখনও পরিত্যাজ্য নয়। কারণ, ইহাদের দ্বারা চিত্ত শুদ্ধি হইয়া থাকে । ৫ হে অর্জুন, ফলের আশা ছাড়িয়া এই সকল কর্ম করিবে, ইহাই আমার মত । ৬ নিয়ত কর্ম কখনও পরিত্যাগ করিতে নাই। অজ্ঞানতাবশত ত্যাগ করিলে তাহা তামসিক ত্যাগ হয় । ৭
দুঃখবােধে যেই জন কর্ম ত্যাগ করে।
রাজসিক সেই ত্যাগ কর্মফল হরে।। ৮
কর্তব্য বলিয়া কর্ম সর্বদা করিবে।
আসক্তি ঘুচিবে আর সাত্ত্বিক হইবে।।৯
মেধাবী সাত্ত্বিক ত্যাগী সংশয়বিহীন।
দুঃখেতে ত্যাজে না কর্ম সুখে প্রীতিহীন।।১০
দেহধারী কভু কর্ম ত্যজিতে নাহি পারে।
কর্মফল ত্যাগী যেই ত্যাগী বলি তারে।।১১
সরলার্থঃ যে ব্যক্তি দুঃখের ভয়ে কর্ম ত্যাগ করে তাহার ত্যাগকে রাজসিক ত্যাগ বলে ।৮ ফলের আশা ছাড়িয়া যে কর্তব্য কর্ম করা হয় তাহাকে সাত্ত্বিক ত্যাগ বলা হয়। ৯ সাত্ত্বিক ত্যাগী ব্যক্তি দুঃখকর কার্যে দুঃখবােধ করেন না, সুখকর কার্যেও আনন্দ পান না। ১০ মানুষ কাজ একেবারে ত্যাগ করিতে পারে না, কিন্তু কর্মের ফল ত্যাগ করিতে পারে। যিনি কর্মের ফল ত্যাগ করিতে পারেন তিনিই ত্যাগী। ১১
ভাল মন্দ মিশ্র এই তিন কর্ম ফল।
সন্ন্যাসীরা কভু নহি ভুঞ্জে এ সকল।।১২
কর্ম সম্পাদনের হয় পাঁচটি কারণ।
বেদান্তে বর্ণিত শুন কুন্তীর নন্দন।।১৩
অধিষ্ঠান কর্তা আর বিবিধ করণ।
কর্তার বিবিধ কার্য আর দৈব হন।।১৪
ভাল মন্দ যাহা কিছু করয়ে মানব।
অবশ্য হইবে তাহা কারণ-সম্ভব।।১৫
সরলার্থঃ ভাল, মন্দ, ভাল-মন্দ মিশ্র – কর্মের এই রকম ফল । ফলত্যাগী সন্ন্যাসিগণ কর্মফল ভােগ করেন না। ১২ বেদান্তমতে কর্মসম্পাদনের পাঁচটি কারণ। তাহা বলিতেছি, শুন। ১৩ অধিষ্ঠান, কর্তা বিবিধ কারণ, কর্তার বিবিধ কার্যও দৈব- এই পাঁচটি কর্মসম্পাদনের কারণ। ১৪ মানুষ ভালমন্দ যাহা কিছু করে তাহা এই পাঁচটি কারণ হইতেই হইয়া থাকে। ১৫
অল্পবুদ্ধিদোষে তাহা বুঝিতে না পারে।
তাই সে ভাবয়ে মনে কর্তা এ আত্মারে।।১৬
অহংভাব ফলাকাঙ্ক্ষা কভু নাহি যার।
জগৎকে বধিলেও নাহি পাপ হয় তার।।১৭
জ্ঞান-জ্ঞেয় আর জ্ঞাতা এ তিন কারণ।
সাংখ্য মতে আছে খ্যাত শুন মতিমান।।১৮
জ্ঞান-জ্ঞেয় জ্ঞাতা-গুণভেদে হয়।
সাংখ্যশাস্ত্রে আছে তাহা শুন ধনঞ্জয়।।১৯
সরলার্থঃ অল্পবুদ্ধি ব্যক্তি তাহা বুঝিতে পারে না। সে আত্মাকেই কর্তা বলিয়া মনে করে। ১৬ যে কর্ম করে কিন্তু ফলের আশা করে না, সে জগৎকে বধ করিলেও পাপের ভাগী হয় না। ১৭ সাংখ্যমতে কারণ তিনটি— জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা। ১৮ জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতা এই তিনটি কারণ-গুণভেদে হয়। বলিতেছি, শােন। ১৯
ভিন্নভাবে সর্বভূতে এক আত্মা হয় ।
তাহাই সাত্ত্বিক জ্ঞান জেনাে ধনঞ্জয়।।২০
বিভিন্ন প্রাণীতে আত্মা ভিন্ন ভিন্ন হন।
রাজসিক এই জ্ঞান পাণ্ডুর নন্দন।।২১
এক কার্যে যেই জ্ঞান পূর্ণাসক্ত হয়।
তুচ্ছরূপ সেই জ্ঞানে তামসিক কয়।।২২
থাকে না আসক্তি কভু ফলাকাংক্ষা নয়।
কর্তব্য হিসাবে কাজ সাত্ত্বিক যে হয়।।২৩
সরলার্থঃ প্রাণীগণ ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু আত্মা এক। এই জ্ঞান সাত্ত্বিক জ্ঞান। ২০ যে মনে করে ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীতে ভিন্ন ভিন্ন আত্মা বিরাজ করেন তাহার জ্ঞান রাজসিক জ্ঞান। ২১ যে জ্ঞানের প্রকৃত তত্ত্ব না বুঝে ‘এই-ই সমস্ত’ এই বুদ্ধি কোন একটি বিষয়ে আসক্ত থাকে। সেই যুক্তিবিরােধী অযথার্থ এবং তুচ্ছ জ্ঞানকে তামসিক জ্ঞান বলে। ২২ যিনি আসক্তি ও ফলাকাংক্ষাহীন এবং যিনি কর্তব্য মনে করিয়াই কাজ করেন, তাঁহার কাজই সাত্ত্বিক কাজ।২৩
আসক্তি ফলাশা কিংবা কষ্টে কৃতযাহা।
করা হয় যেই কর্ম রাজসিক তাহা।।২৪
পরিণাম ক্ষয় হিংসা অথবা পৌরুষ।
না ভাবিয়া কৃত কর্ম অবশ্য তামস।।২৫
ফলাফলে নির্বিকার নাই অহংকার।
সাত্ত্বিক সেই সে কর্তা জেনাে এই সার।।২৬
আসক্ত লােভী আর লাভে আনন্দিত।
রাজসিক কর্তা সেই অলাভে দুঃখিত।।২৭
সরলার্থঃ যে ব্যক্তি আসক্তিবশত ফলের আশায় কিংবা কষ্টের সহিত কাজ করে তাহার কাজ রাজসিক কাজ। ২৪ যে ব্যক্তি পরিণাম, ক্ষয়, হিংসা কিংবা নিজের পৌরুষ না ভাবিয়া কাজ করে তাহার কাজ তামসিক কাজ। ২৫ যে ব্যক্তি ফলাফলে নির্বিকার, যাহার অহংকার নাই, সে সাত্ত্বিক কর্তা। ২৬ যে ব্যক্তি আসক্ত, লােভী, লাভে আনন্দিত ও অলাভে দুঃখিত হয়, সে রাজসিক কর্তা। ২৭
অভদ্র অলস ব্যক্তি দীর্ঘসূত্র আর।
তামসিক সেই কর্তা মূর্তি শঠতার।।২৮
ত্রিবিধ বুদ্ধি ও ধৃতি গুণ অনুসারে।
ইহাদের কথা এবে বলিব তােমারে।।২৯
প্রবৃত্ত্যাদি কার্যাকার্য আর ভয়াভয়।
মােক্ষামােক্ষ বােধবুদ্ধি সাত্ত্বিকী যে হয়।।৩০
ধর্মাধর্ম কার্যাকার্য বুঝা নাহি যায় ।
সেই বুদ্ধি রাজসিক জানিবে নিশ্চয়।।৩১
সরলার্থঃ যে ব্যক্তি অভদ্র, অলস, শঠ ও দীর্ঘসূত্রী সে তামসিক কর্তা। ২৮ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—এই তিনগুণ অনুসারে বুদ্ধি ও ধৃতি তিন প্রকার । এখন তােমাকে তাহা বলিতেছি। ২৯ যে বুদ্ধি দ্বারা প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি, কর্তব্য-অকর্তব্য, ভয়-অভয়, মুক্তি ও বন্ধন নির্ণয় করা যায় তাহা সাত্ত্বিক বুদ্ধি ।৩০ যে বুদ্ধি দ্বারা ধর্ম অধর্ম, কর্তব্য অকর্তব্য প্রভৃতি বুঝা যায় না তাহা ‘রাজসিক বুদ্ধি’ । ৩১
অধর্মেতে ধর্মবােধ অজ্ঞানতাবশে।
তামসিক এই বুদ্ধি জানিবে বিশেষে।।৩২
সাত্ত্বিক যাহার ধৃতি সহজে সে জন।
মন প্রাণ ইন্দ্রিয়কে করে যে দমন।।৩৩
রাজসী ধৃতির বলে বাসনা জাগায়।
ধর্ম অর্থ কাম মােক্ষ কভু বড় নয়।৩৪
তামসী ধৃতির বলে মন্দমতি জন।
নিদ্রা ভয় শােক দুঃখে লভয়ে বন্ধন।।৩৫
সরলার্থঃ তামসিক বুদ্ধির বলে মানুষ অধর্মকেই ধর্ম বলিয়া মনে করে। ৩২ এখন ধৃতির কথা বলিতেছি। সাত্ত্বিক ধৃতির বলে মানুষ মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়কে সহজে দমন করিতে পারে ।৩৩ যাহার রাজসিক ধৃতি তাহার বাসনা প্রবল হয়। সেই ব্যক্তি ধর্ম, অর্থ-কাম-মােক্ষ অপেক্ষাও. বাসনাকে বড় মনে করে। ৩৪ তামসিক ধৃতির বলে মানুষ নিদ্রা, ভয় ও শােক-দুঃখে আচ্ছন্ন হইয়া পড়ে । ৩৫
ত্রিবিধ সুঃখের কথা বলিব অর্জুন।
সাত্ত্বিক রাজসিক আর তামসিক তিন।।৩৬
সাত্ত্বিক সুখেতে হয় আনন্দ উদয় ।
সর্ব দুঃখ দূর হয় অন্ত সুখময়।।৩৭
ইন্দ্রিয় সঞ্জাত সুখ নামেতে রাজস।
প্রথমে অমৃত তুল্য পরিণামে বিষ।।৩৮
নিদ্রালস্য প্রমাদজ তামসিক সুখে।
সর্বদা মানব মন সমাচ্ছন্ন রাখে।।৩৯
সরলার্থঃ হে অর্জুন, সুখও ত্রিবিধ সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। সে সম্বন্ধে তােমাকে বলিতেছি। ৩৬ সাত্ত্বিক সুখে আনন্দ জাগে, সমস্ত দুঃখ দূরে যায় এবং পরিণাম সুখের হয়। ৩৭ রাজসিক সুখ ইন্দ্রিয় হইতে জন্মে। ইহা প্রথমে খুবই আনন্দের, কিন্তু পরিণামে দুঃখময়। ৩৮ নিদ্রা, আলস্য ও প্রমাদ হইতে যে সুখ জন্মে তাহা তামসিক সুখ। ইহা সর্বদাই মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে। ৩৯
দেবতা মানব আর কোন জীব।
কাটাইতে নাহি পারে প্রকৃতি প্রভাব।।৪০
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য আর শূদ্র যত ।
বিভক্ত হয়েছে কর্ম গুণে স্বভাবত।।৪১
শম দম ক্ষমা জ্ঞান তপ সরলতা।
ব্ৰহ্ম কর্ম হয় শৌচ আস্তিক্য শুচিতা।।৪২
শৌর্য বীর্য পরাক্রম আর যুদ্ধকৰ্ম ।
শাসন-প্রভুত্ব ভাব ক্ষত্রিয়ের ধর্ম।।৪৩
সরলার্থঃ দেবতা, মানব বা অন্য কোন প্রাণীই স্বভাব কাটাইয়া উঠিতে পারে না। ৪০ স্বভাবের গুণেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র—এই চারি জাতির কর্ম বিভক্ত হইয়াছে। ৪১ শম, দম, ক্ষমা, তপস্যা, শৌচ, আস্তিক্য, শুচিতা, জ্ঞান, সরলতা—এইসব ব্রাহ্মণের কর্ম। ৪২ শৌর্য, বীর্য, পরাক্রম, যুদ্ধ, শাসন, প্রভুত্ব–এইসব ক্ষত্রিয়ের কর্ম। ৪৩
গাে-রক্ষা কৃষি বাণিজ্য এ তিন বৈশ্যের।
সেবাকার্য এক ধর্ম হয় যে শূদ্রের।।88
নিজ কর্মে হয়ে নিষ্ঠ সিদ্ধি লভে জন।
কেমনে লভয়ে সিদ্ধি শুনহ অর্জুন।।৪৫
সর্বভূতে অধিষ্ঠিত যিনি বিশ্বময়।
স্বধর্ম পালনে পার্থ তাঁরি পূজা হয়।।৪৬
স্বদোষ স্বধর্ম বড় পরধর্ম হতে।
স্বধর্মে রতের পাপ নাই কোন মতে।।৪৭
সরলার্থঃ কৃষিকার্য, গােগালন ও বাণিজ্য বৈশ্যের কর্ম। আর সেবা হইতেছে শূদ্রের কর্ম। মানুষ নিজ নিজ কর্মে রত থাকিয়াই সিদ্ধি লাভ করে। এ সম্বন্ধে তােমাকে বলিতেছি। ৪৫ হে অর্জুন, মানুষ স্বধর্ম পালন করিয়া যিনি সর্বভূতে অধিষ্ঠিত সে-ই বিশ্বময়ের পূজা করিয়া থাকেন। ৪৬ স্বধর্ম দোষযুক্ত হইলেও পরধর্ম হইতে বড়। যে স্বধর্ম পালন করে তাহার কোন পাপ হয় না। ৪৭
স্বদোষ স্বধর্ম কিন্তু পরিত্যাজ্য নয়।
অগ্নিদেব ধূমময় যথা সদা রয়।।৪৮
অনাসক্ত হয়ে কর কর্ম সম্পাদন।
কর্মবন্ধ মুক্ত সেই জিতেন্দ্রিয় জন।।৪৯
সিদ্ধি লাভে ব্রহ্মভাব কি ভাবেতে হয় ।
সেই জ্ঞান এবে তুমি শােন ধনঞ্জয়।।৫০
বুদ্ধি দ্বারা মন তুমি নির্মল করিবে।
ভােগের বিষয় সব তাতে দূর হবে।।৫১
সরলার্থঃ স্বধর্ম দোষযুক্ত হইলেও ইহা কখনও পরিত্যাগ করিবার নয়। অগ্নিতে যেমন ধূম (ধােয়া) থাকে, স্বধর্মেও তেমন কিছুটা দোষ থাকিবেই। ৪৮ যে সংযত ব্যক্তি অনাসক্ত হইয়া কর্ম করে সে কর্মের বন্ধন হইতে মুক্ত হয়। ৪৯ হে অর্জুন, সিদ্ধিলাভ করিলে কিভাবে ব্ৰহ্মভাব হয়। তাহা তােমাকে বলিব। ৫০ বুদ্ধি দ্বারা মনকে নির্মল ও সংযত করিবে। তবেই ভােগের বিষয় সকল দূর হইয়া যাইবে। ৫১
নিরিবিলি থাকিবে ও নিরামিষ খাবে।
তাহাতে শরীর মন সংযত রহিবে।।৫২
অহংকার বল দর্প কাম-ক্রোধ লােভ ।
ত্যাজিলে নির্মল হয় নাহি রয় ক্ষোভ।।৫৩
ব্ৰহ্মভূত প্রসন্নাত্মা দুঃখ নাহি করে।
সর্বভূতে সমভাব ভক্তি মাের তরে।।৫৪
ভক্তিতে জানিতে পারে সর্বব্যাপী মােরে ।
স্বরূপত জানি ভক্ত মােতে প্রবেশ করে।।৫৫
সরলার্থঃ নিরিবিলি থাকিলে ও নিরামিষ খাইলে মন সংযত হয়। ৫২ অহংকার, বল, কাম, ক্রোধ, লােভ ত্যাগ করিতে পারিলে মন নির্মল হয়। ৫৩ ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হইলে মন সুপ্রসন্ন হয়। তখন সর্বভূতে সমদৃষ্টি হয় এবং আমার প্রতি ভক্তি লাভ করে। (অর্থাৎ আমার ভক্ত হয়)। ৫৪ আমি সর্বব্যাপী। ভক্তি ভরে আমার স্বরূপ জানিয়া আমার ভক্ত আমাতেই প্রবেশ করে। ৫৫
সর্ব কর্ম করিয়াও আমার আশ্রয়ে।
আমার প্রসাদে লভে পদ সে অব্যয়ে।৫৬
সর্বকর্ম সমর্পণ করিয়া আমাতে ।
স্বকর্ম করহ পার্থ মদ্-গতচিত্তে।।৫৭
মদ্-গতচিত্ত হলে সর্ব দুঃখ যাবে।
অহংকারে না শুনিলে মঙ্গল না পাবে।।৫৮
অহংকার বশে বল-“যুদ্ধ করিব না”।
প্রকৃতি করাবে যুদ্ধ, মিথ্যা সে ভাবনা।।৫৯
সরলার্থঃ আমার ভক্ত সমস্ত কর্ম করিয়াও আমার অনুগ্রহে অব্যয় পদ প্রাপ্ত হয়। ৫৬ হে অর্জুন, তুমিও সমস্ত কর্মের ফল আমাতে সমর্পণ করিয়া এবং আমাতে মনপ্রাণ রাখিয়া স্বকর্ম করিতে থাক। ৫৭ মদ্-গত চিত্ত হইয়া আমার উপদেশ অনুসারে চলিলেই তােমার মঙ্গল হইবে । ৫৮ অহংকারবশত যদিও তুমি বল-“আমি যুদ্ধ করিব না ” ইহা ভূল” । প্রকৃতিই তােমাকে কাজ করাইবে।৫৯
স্বভাবজ যুদ্ধ কর্ম এবে না করিবে।
প্রকৃতি করাবে শেষে অবশ্য বুঝিবে।।৬০
সর্বভূতে হৃদে থাকি ঈশ্বর মায়ায় ।
সকলে নাচান নিত্য যন্ত্রারূঢ় প্রায়।।৬১
তাহার শরণ লহ ওহে মতিমান।
তবেই মিলিবে শান্তি আর নিত্য স্থান।৬২
অতিগুহ্য তত্ত্বকথা কহিনু তােমায়।
বুঝিয়া করহ কার্য যাহা মনে লয়।।৬৩
সরলার্থঃ যুদ্ধ তোমার স্বাভাবিক কর্তব্য। তুমি যদি স্বেচ্ছায় যুদ্ধ না কর, তবে শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির প্রভাবে তুমি যুদ্ধ করিতে বাধ্য হইবে। ৬০ ঈশ্বর সকল প্রাণীর মধ্যে আছেন। তিনিই তাহাদিগকে যন্ত্রারূঢ় পুতুলের মত ঘুরাইতেছেন। ৬১ হে অর্জুন, তুমি সবর্ভাবে তাঁহারই শরণ লও। তাঁহার অনুগ্রহেই তুমি শান্তি ও নিত্য স্থান লাভ করিবে। ৬২ অতিগুহ্য এই কথা তােমাকে বলিলাম। ইহা শুনিয়া যাহা সঙ্গত মনে কর তাহাই করিও। ৬৩
সর্বগুহ্যতম কথা শােন পুনরায় ।
কহিতেছি পার্থ তব হিত কামনায়।।৬৪
মন্মনা মদভক্ত হও মতি কর মােরে।
অতি প্রিয় ভক্ত তুমি বলি সত্য করে।।৬৫
সর্বধর্ম ছাড়ি লও আশ্রয় আমার।
সর্বপাপে পাবে ত্রাণ দুঃখ নাহি আর।।৬৬
ভক্তিহীন তপােহীন নিন্দা করে মােরে।
বলিবে না গীতাশাস্ত্র তাদৃশ জনেরে।।৬৭
সরলার্থঃ তােমার ভালর জন্য সর্বাপেক্ষা গুহ্য(গোপনীয়) কথাটি তােমাকে এখন বলিব। ৬৪ আমাতে মন নিবিষ্ট কর; আমার ভক্ত হও, আমাকে নমস্কার কর। তাহা হইলে তুমি আমাকেই পাইবে, কেননা তুমিই আমার অতি প্রিয়। ৬৫ সমস্ত ধর্মকর্ম বাদ দিয়া তুমি আমারই শরণ লও। আমি তােমাকে সকল পাপ হইতে মুক্ত করিব। ৬৬ যে ভক্তিহীন, স্বধর্মে যাহার নিষ্ঠা নাই এবং যে আমার নিন্দা করে, সেই সব ব্যক্তিকে, গীতাশাস্ত্র বলিবে না। ৬৭
ভক্তিভাবে গীতা শাস্ত্র ভক্ত জনে কয়।
সেইজন্য মােরে পার্থ পাইবে নিশ্চয়।।৬৮
তার চেয়ে প্রিয় মাের কেহ নাই আর ।
সে জন্য করয়ে প্রিয় কার্যটি আমার।।৬৯
যে জন পঠয়ে গীতা সর্ব ধর্মসার।
জ্ঞানরূপ যজ্ঞে পূজা করে সেই মাের।।৭০
শ্রদ্ধার সহিত গীতা-পাঠ করে যেই।
পাপমুক্ত হয়ে পুণ্যলােক পায় সেই।।৭১
সরলার্থঃ যে ব্যক্তি ভক্তির সহিত গীতাশাস্ত্র ভক্তজনদিগকে পাঠ করিয়া শােনায় সে অন্তিমে আমাকেই পাইয়া থাকে। ৬৮ মানুষের মধ্যে তাহার চেয়ে প্রিয় আমার আর কেহ নাই। ৬৯ যিনি গীতা পাঠ করিবেন, তিনি জ্ঞানরূপ যজ্ঞদ্বারা আমারই পূজা করিবেন—ইহাই আমি মনে করি। ৭০ যে ব্যক্তি ভক্তির সহিত গীতা শাস্ত্র শ্রবণ করে, তিনি পাপমুক্ত হইয়া পুণ্যলােক প্রাপ্ত হয়। ৭১
একচিত্তে শুনেছ ত বচন আমার।
কেটেছে ত ধনঞ্জয় সম্মােহ তােমার।।৭২
অর্জুন কহিলেন
কাটিয়াছে মােহ কৃষ্ণ তােমার কৃপায়।
হয়েছে সুস্থির মন, নাহিক সংশয়।।৭৩
সঞ্জয় কহিলেন
শুনিয়াছি মহারাজ কথােপকথন।
যা বলিলা কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণ ও অর্জুন।।৭৪
সরলার্থঃ হে অর্জুন, তুমি মন দিয়া আমার কথা শুনিয়াছ ত? তােমার মােহ দূর হইয়াছে তাে।৭২ অর্জুন বলিলেন হে কৃষ্ণ, তােমার অনুগ্রহে আমার মােহ দূর হইয়াছে। আমার মন স্থির। আমার মনে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নাই। ৭৩ সঞ্জয় বলিলেন হে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের এই কথােপকথন আমি শুনিয়াছি। ৭৪
শুনেছি এ গুহ্য কথা ব্যাসের কৃপায়।
কহিলেন কৃষ্ণ নিজে শ্রোতা ধনঞ্জয়।।৭৫
এই পুণ্য কথা নৃপ স্মরি বার বার।
হইতেছে মূহুর্মুহু আনন্দ আমার।।৭৬
বিশ্বরূপ-দৃশ্য যত ভাবিতেছি মনে।
ততই পুলক মাের হইতেছে মনে।।৭৭
যােগেশ্বর কৃষ্ণ আর পার্থ ধনুর্ধর যেথা।
জয় আর রাজলক্ষ্মী বিরাজিবেন সেথা।।৭৮
সরলার্থঃ মহর্ষি ব্যাসের অনুগ্রহে আমিই এই গীতা শ্রীকৃষ্ণকে বলিতে ও অর্জুনকে শুনিতে শুনিয়াছি। ৭৫ এই পুণ্যকথা আমি বার বার স্মরণ করিতেছি, আর বার বার আমার আনন্দ হইতেছে। ৭৬ বিশ্বরূপের দৃশ্যটি যতই আমার মনে পড়িতেছে ততই শরীর পুলকিত হইতেছে। ৭৭ যেখানে যােগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ ও বীর অর্জুন বিরাজমান, সেখানেই জয় ও রাজলক্ষ্মী বিরাজ করিবেন—ইহাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ৭৮
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের সার-সংক্ষেপ
অষ্টাদশ অধ্যায়ে মােক্ষযােগের কথা বলা হইয়াছে। এই অধ্যায়ের গােড়ায় ত্যাগ ও সন্ন্যাস- এই দুইটি কথা আছে। কাম্য কর্মের ত্যাগের নাম সন্ন্যাস। আর সর্বকর্মের ফলত্যাগের নাম ত্যাগ। মূলত দুই-ই এক। সুতরাং যিনি ফলত্যাগী তিনিই প্রকৃত সন্ন্যাসী। প্রত্যেক কর্মেই কিছু না কিছু দোষ থাকেই। তথাপি দেহধারী কোন প্রাণীই কর্ম ত্যাগ করিতে পারে না। যে ফলত্যাগী সেই প্রকৃত ত্যাগী। ঈদৃশ ব্যক্তি কর্ম করিয়াও কর্ম বন্ধনে আবদ্ধ হয় না। যে ফলত্যাগ করে না, সে-ই ভাল মন্দ ফলে আবদ্ধ হয়। মানুষ কর্ম করে প্রকৃতির প্রভাবে। যে মনে করে “আমি কর্ম করি, সে ভুল ভাবে। এখানে মূলত প্রকৃতিরই গুণভেদ আছে। এই গুণভেদ অনুযায়ী যাহার যে কর্ম শাস্ত্রে নির্দিষ্ট করা হইয়াছে, সেই কর্ম করাই তাহার স্বধর্ম । তাহা পালন করা প্রত্যেক মনুষ্যেরই কর্তব্য।
কর্মমাত্রই কোন বিষয়ে দোষযুক্ত হইতে পারে। কিন্তু ফলের আশা ত্যাগ করিয়া সেই কর্ম করিলে তাহাতে বন্ধন ঘটে না। ইহাকে নৈস্কর্ম সিদ্ধি বলে। এই সিদ্ধিলাভ হইলে যােগী ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন। তখন তাঁহার সর্বভূতে সমদর্শন ও নির্মল চিত্তপ্রসাদ লাভ হয়। ফলে ভগবানে পরাভক্তি জন্মে এবং ভক্ত তাহা দ্বারা ভগবানে তন্ময় হইয়া যান। গীতায় অর্জুনের প্রতি ভগবানের শেষ উপদেশ হইল এই—নানা ধর্মের নানারূপ বিধি নিষেধ। সবকিছু ত্যাগ করিয়া তুমি আমার শরণ লও। আমি তােমাকে সর্বপাপ হইতে মুক্ত করিব। ।
ইতি মােক্ষযোগ নামক অষ্টাদশ অধ্যায়।
আরো পড়ুন:
মঙ্গলাচরণ | প্রথম অধ্যায় | দ্বিতীয় অধ্যায় | তৃতীয় অধ্যায় | চতুর্থ অধ্যায় | পঞ্চম অধ্যায় | ষষ্ঠ অধ্যায় | সপ্তম অধ্যায় | অষ্টম অধ্যায় | নবম অধ্যায় | দশম অধ্যায় | একাদশ অধ্যায় | দ্বাদশ অধ্যায় | ত্রয়োদশ অধ্যায় | চতুর্দশ অধ্যায় | পঞ্চদশ অধ্যায় | ষােড়শ অধ্যায় | সপ্তদশ অধ্যায় | সংক্ষিপ্ত-মাহাত্ম্যম | সম্পূর্ণ-মাহাত্ম্যম | ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র।
0 মন্তব্যসমূহ