শ্রীশ্রী গীতা-মাহাত্ম্যম
শৌনক (ঋষি) কহিলেন
গীতার মাহাত্ম্য সূত করহ বর্ণন।
পুরাকালে ব্যাসদেব কহিলা যেমন।।১
সূত কহিলেন
ব্যাসদেব বলেছেন মাহাত্ম যাহার।
সেই তত্ত্ব প্রচারিতে শক্তি আছে কার।।২
কৃষ্ণ অবগত সব পার্থ কিঞ্চিৎ ফল।
ব্যাস, ব্যাসপুত্র যাজ্ঞবল্ক্য বা মৈথিল।।৩
শুনেছি কিছুটা আমি নিকটে ব্যাসের।
বলিব হে মুনিবর কাছে আপনার ।।৪
উপনিষদগুলি গাভী দোগ্ধা নারায়ণ।
পার্থ বৎস কথা দুগ্ধ পিয়ে সুধীগণ ।।৫
পার্থের সারথি রূপে গীতামৃত দানে।
নমস্কার করি আমি সেই নারায়ণে।।৬
সংসার-সাগর ঘাের পার হতে চায়।
আরােহিয়া গীতাতরী সুখে চলি যায়।।৭
গীতাভ্যাস না করিয়া মােক্ষবাঞ্ছা করে।
বালকেও উপহাস করে সে মূঢ়েরে ।।৮
দিবারাত্র গীতাশাস্ত্র যে করে পঠন।
জানিও দেবাত সেই ধন্য সেই জন।।৯
গীতাজ্ঞানে ব্ৰহ্মতত্ত্ব শীঘ্র লাভ হয়।
ব্ৰহ্মতত্ত্বে ভক্তিরস স্বত উপজয়।।১০
ভক্তি-মুক্তিলাভ সেই আঠার অধ্যায়।
তাহা জানি ক্রমে ক্রমে চিত্তশুদ্ধি হয়।।১১
শ্রদ্ধায় করিলে স্নান গীতাতত্ত্ব জলে।
পাপ যায়, শ্রদ্ধাহীনের সকল বিফলে।।১২
যে জন না করে গীতা, পঠন-পাঠন ।
সকল বিফল তার অধম সে জন।।১৩
গীতার মাহাত্ম্য-কথা জানে না যে জন।
বিফল জীবন তার সেই সে অজ্ঞান।।১৪
যে জন তাৎপর্য না জানে গীতার।
অধম সে, বিভবেতে শত ধিক্ তার।।১৫
যে না জানে গীতা তার ধিক্ প্রতিষ্ঠায়।
প্রারব্ধে মহত্ত্বে ধিক্ দানে ও পূজায়।।১৬
গীতা শাস্ত্রে মতি নাই সব বৃথা তার।
জ্ঞান জ্ঞানদাতা ব্রতনিষ্ঠা আর।।১৭
অর্থ সহ যেই জন গীতা নাহি পড়ে।
নিষ্ফল তাহার জ্ঞান একান্ত অসুরে।।১৮
ধর্মময় গীতা শাস্ত্র দানে সব জ্ঞান।
নাহিক পবিত্র কিছু তাহার সমান।।১৯
বিষ্ণু পর্বে যেই জন গীতা পাঠ করে।
শত্রু কভু ক্ষতি তার করিতে না পারে।।২০
শালগ্রামে দেবালয়ে তীর্থে নদীতীরে।
সৌভাগ্য অপার হয় গীতাশাস্ত্র পাঠে ৷ ৷২১
গীতাপাঠে তুষ্ট হন দেবকীনন্দন।
যজ্ঞব্রতাদিতেও হেন প্রীত নন।।২২
ভক্তিভরে গীতাশাস্ত্র যেবা পাঠ করে।
সর্বশাস্ত্র প্রতিভাত তাহার অন্তরে।।২৩
যােগ আর সিদ্ধপীঠে শিলাগ্রে সভায়।
যজ্ঞে বিষ্ণু ভক্তস্থানে পড়ে সিদ্ধি পায়।।২৪
প্রতিদিন গীতাপাঠ করিলে বা শুনিলে।
অশ্বমেধ যজ্ঞ ফল সহজেই মিলে।।২৫
গীতার্থ শােনেন কিংবা অপরে শােনান।
অথবা কীর্তন করি তিনি মুক্তি পান।।২৬
ভক্তি ভরে গীতা দান যেই জন করে।
গৃহলক্ষ্মীপ্রিয়া ভার্যা তাহার সংসারে।।২৭
সৌভাগ্য আরােগ্য যশ লভে সর্বসুখ।
দয়িতার প্রিয় হয় নাহি কোন দুঃখ ।।২৮
যেই গৃহে হয় নিত্য গীতার অর্চন।
না পারে পশিতে সেথা অশুভ কখন।।২৯
তাপত্রয় জাত ঘটে না সেখানে।
নিয়মিত গীতাপাঠ হয় যে সদনে।।৩০
বিস্ফোটকাদি আদি তার দেহে নাহি হয়।
কৃষ্ণপদে দাস্য ভক্তি, সর্বদা লভয়।।৩১
যে জন সর্বদা থাকে গীতাপাঠে রত।
সকলের সাথে তার বন্ধুতা সতত।।৩২
গীতাধ্যায়ীরাও অতি পাপী হয়।
পদ্মপত্রে জলতুল্য সর্বপাপ ক্ষয়।।৩৩
গীতাপাঠী করে যদি পাপ অনাচার।
অভক্ষ্যভোজন দোষ স্পর্শে না তাহার।।৩৪
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে যত পাপ কার্য করে।
গীতা পাঠের গুণে সেই সব হরে।।৩৫
যেখানে সেখানে খায় কিংবা লয় দান।
গীতাপাঠী তাহে পাপী না হয় কখন।।৩৬
অন্যায় ভাবেতে যদি মহী হরি লয়।
গীতাপাঠের ফলে তাও শুদ্ধ হয়।।৩৭
মনপ্রাণ সদা যার বিরাজে গীতায়।
পণ্ডিত ও ক্রিয়াবান সেই জন হয়।।৩৮
দর্শনীয় ধনবান যােগী জ্ঞানী যিনি ।
বেদার্থদর্শক আর যাজ্ঞিক যে তিনি।।৩৯
গীতাপাঠ নিত্য নিত্য হইবে যেখানে।
সর্বতীর্থসার তাহা রাখিবে স্মরণে।।৪০
প্রতিদিন করে যেই গীতার পঠন।
জীবনে-মরণে তারে রক্ষে দেবগণ।।৪১
গীতাগ্রন্থ পাঠ করা হয় যেই স্থানে।
ভক্তগণ সহ কৃষ্ণ বিরাজে সেখানে।।৪২
যেইখানে গীতাশাস্ত্র আলােচনা হয়।
রাধার সহিত কৃষ্ণ বিরাজে সেথায় ৷ ৷ ৪৩
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন
গীতা মাের প্রাণ পার্থ গীতা মাের সার।
গীতা হয় শ্রেষ্ঠ জ্ঞান জানিবে আমার।।৪৪
গীতাই উত্তম স্থান গীতা পরম পদ।
গীতা যে পরম গুহ্য শ্রীগুরু আস্পদ ৷ ৷৪৫
গীতাশ্রয়ে বাস করি গীতা যে জীবন।
জ্ঞানাশ্রয়ে গীতা মম ত্রিলােক পালন।।৪৬
গীতা মাের ব্রহ্মবিদ্যা নাহিক সংশয়।
বাক্যাতীতা সনাতনী মাত্রারূপা হয়।।৪৭
প্রত্যহ স্থির চিত্তে জপে এ সকল নাম।
সিদ্ধিজ্ঞান লাভ হয় পুরে মনস্কাম।।৫১
সম্পূর্ণ পড়িতে গীতা নাহি পর যদি।
অর্ধেক পড়িলে ফল গো-দান অবধি।।৫২
ত্রিভাগ করিলে পাঠ ফল সােমযােগ।
যড়ংশ পাঠেতে হয় গঙ্গাস্নান ভাগ ৷ ৷৫৩
নিত্য পাঠে দ্বি-অধ্যায় ইন্দ্রলােকে যায়।
এক কল্পকাল বাসে তথা শান্তি পায়।।৫৪
একাধ্যায় পাঠ করে ভক্তির সহিত।
রুদ্রলােক প্রাপ্তি তার হইবে নিশ্চিত ৷।৫৫
অধ্যায়ার্ধ কিংবা পাদ নিত্য পাঠ করে।
ভুঞ্জিবেক রবিলােক শত মন্বন্তরে।।৫৬
দশ সাত পাঁচ চার শ্লোক দুই এক।
পাঠ করি প্রতিদিন পায় চন্দ্রলােক।।৫৭
দুই এক শ্লোক পড়ি যে বা মারা যায়।
দেহ ত্যজি সেই জন পর পদ পায়।।৫৮
মরিলে শুনিয়া গীতা মহাপাপী জন।
মহাপাপ দূরে যায় মুক্তিভাগী হন।।৫৯
গীতা বুকে লয়ে করে প্রাণ বিসর্জন।
বিষ্ণুর সহিত বাস বৈকুণ্ঠে গমন।।৬০
যে জন জীবন ত্যজে লয়ে গীতাধ্যায়।
পুণ্যবলে সেই পুনঃ নবজন্ম পায়।।৬১
বলিতে বলিতে “গীতা” যে জন মরয়।
পরলােকে কিন্তু তার শুভগতি হয়।।৬২
গীতা পাঠ করি যেই কর্ম আরম্ভন।
সুসম্পন্ন হয় কাজ নির্দোষ ভাষণ ৷ ৷৬৩
পিতৃশ্রাদ্ধে গীতাপাঠ করে যেই জন।
সন্তুষ্ট হইয়া পিতা করে স্বর্গেতে গমন।।৬৪
গীতা পাঠে পরিতুষ্ট হয়ে পিতৃগণ।
আশীর্বাদ করি, পুত্রে, পিতৃলােকে যান।।৬৫
ধেনুপুচ্ছ সমন্বিত গীতা করে দান।
সেদিন হয় দাতার বাসনা পূরণ।।৬৬
স্বর্ণযুক্ত গীতাগ্রন্থ বিপ্রজনে দিলে।
দাতার কখনাে আর জন্ম নাহি মিলে।।৬৭
একশত গীতাগ্রন্থ করিলে প্রদান।
পুনর্জন্ম নাহি তার ব্রহ্মলােকে যান।।৬৮
গীতাগ্রন্থ প্রদানের এই শুভ ফল।
বিষ্ণুর সহিত বাস সপ্তকল্প কাল।।৬৯
গীতা শুনি অর্থ বুঝি করে গীতা দান।
তার প্রতি তুষ্ট রহে জেনাে ভগবান।।৭০
দ্বিজ-আদি চারিবর্ণ গীতা নাহি পড়ে।
হস্তের ফেলিয়া সুধা বিষ পান করে।।৭১
দুঃখার্ত ব্যক্তি যদি লভে গীতা জ্ঞান।
গীতামৃত পানে তিনি ভক্তিসুখ পান।।৭২
জনকাদি রাজগণ পড়িয়া গীতায়।
বন্ধন বিহীন হয়ে সবে মুক্তি পায়।।৭৩
গীতাজ্ঞানে ভেদ নাই উচ্চ নীচ জনে।
ব্রহ্মরূপ গীতা হয় তুল্য শ্রেষ্ঠ জ্ঞানে।।৭৪
নিন্দা করে গীতাগ্রন্থ অহংকারভরে।
আপ্রলয় নরকেতে সেই বাস করে।।৭৫
দর্পভরে গীতা-অর্থ মানে না যে জন ।
অতি মূঢ় সেই জন নরকে পচন।।৭৬
কাছে থাকি নাহি করে গীতার্থ শ্রবণ ।
বহুবার লভে জন শূকর জনম।।৭৭
গীতাগ্রন্থ চুরি করে শােন তার ফল।
পঠনাদি কর্ম যত তাহার বিফল।।৭৮
গীতার্থ শুনিয়া যে-বা আনন্দ না পায়।
পাগলের শ্রমতুল্য পাঠ বৃথা হয়।।৭৯
গীতাপাঠ শুনি যে-বা যাহা করে দান।
সাদরে গ্রহণ করেন তাহা ভগবান।।৮০
পাঠককে তােষেণ যদি দিয়া নানা দান।
পরিতুষ্ট হন তাহে দেব নারায়ণ।।৮১
সূত কহিলেন
পুরাতন এ মাহাত্ম্য শ্রীকৃষ্ণ কথিত।
গীতান্তে পড়িলে ফল লাভ সুনিশ্চিত।।৮২
গীতা পড়ি নাহি করে মাহাত্ম্য-পঠন।
বৃথা গীতা পাঠ তার বিফল যতন।।৮৩
গীতা পড়ি, যেই জন মাহাত্ম্য পঠয় ।
শ্রদ্ধার সহিত শুনে পরাগতি হয়।।৮৪
ব্যাখ্যাসহ গীতা শুনি’ মাহাত্ম্য শুনিলে।
সর্ব সুখ হয়ে থাকে সেই পুণ্য ফলে ৷ ৷৮৫
ইতি গীতা-মাহাত্ম্য সমাপ্ত।
আরো পড়ুন:
মঙ্গলাচরণ | প্রথম অধ্যায় | দ্বিতীয় অধ্যায় | তৃতীয় অধ্যায় | চতুর্থ অধ্যায় | পঞ্চম অধ্যায় | ষষ্ঠ অধ্যায় | সপ্তম অধ্যায় | অষ্টম অধ্যায় | নবম অধ্যায় | দশম অধ্যায় | একাদশ অধ্যায় | দ্বাদশ অধ্যায় | ত্রয়োদশ অধ্যায় | চতুর্দশ অধ্যায় | পঞ্চদশ অধ্যায় | ষােড়শ অধ্যায় | সপ্তদশ অধ্যায় | অষ্টাদশ অধ্যায় | সংক্ষিপ্ত-মাহাত্ম্যম | ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র।
0 মন্তব্যসমূহ