দ্বিতীয় অধ্যায়
সাংখ্যযােগ
সঞ্জয় কহিলেন
শোকাকুল দুঃখপূর্ণ সজল নয়ন।
হেরিয়া অর্জুনে কন শ্রীমধুসূদন ।।১
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন
এ বিপদে কেন তব এ মােহ উদয় ।
নিন্দনীয় ইহা পার্থ আৰ্য্যোচিত নয় ।।২
ত্যজ মােহ, ছাড় ক্লৈব্য, উঠ ধনঞ্জয়।
হেন ক্ষুদ্র দুর্বলতা তব যােগ্য নয়।।৩
সরলার্থঃ সঞ্জয় বলিলেন—অর্জুনকে শােকাকুল, দুঃখিত ও অশ্রুসিক্ত দেখিয়া শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন।১ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন—হে অর্জুন, এই বিপদের সময় তােমার এরূপ মােহের উদ্ভব হইল কেন? ইহা আর্যজনােচিত নয়। বরং অতিশয় নিন্দনীয়।২ হে অর্জুন, মােহ ত্যাগ কর। দুর্বলতা দূর কর। এইরূপ দুবর্লতা তােমার সাজে না।৩
অর্জুন কহিলেন
কেমনে করিব রণে বাণ নিক্ষেপণ।
পূজ্যপাদ ভীষ্ম দ্রোণে, হে মধুসূদন।।৪
গুরুহত্যা না করিয়া ভিক্ষান্ন খাইব।
গুরু রক্ত লিপ্ত রাজ্য ভােগ না করিব।।৫
জয় পরাজয় কিবা ভাল কহ মােরে।
অবধ্য বান্ধবগণ সম্মুখ সমরে।।৬
সরলার্থঃ অর্জুন বলিলেন— হে কৃষ্ণ, যুদ্ধক্ষেত্রে পূজ্যপাদ ভীষ্ম ও দ্রোণের প্রতি আমি কিরূপে বাণ নিক্ষেপ করিব?8 আমি গুরুজনদিগকে হত্যা করিব না। তাঁহাদের রক্তে রঞ্জিত রাজ্যও ভােগ করিব না। বরং আমি ভিক্ষান্ন খাইয়া জীবন ধারণ করিব ।৫ অবধ্য আত্মীয়স্বজনগণ যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষে দাঁড়াইয়া আছেন। জয় এবং পরাজয়— ইহাদের কোনটি আমার পক্ষে মঙ্গলজনক তাহা বল ৷৬
মূঢ় আমি, দীন আমি, কুলক্ষয়ে ভীত।
উপদেশ দাও শিষ্যে তব পদাশ্রিত।।৭
শত্রুহীন রাজ্যে কিংবা ইন্দ্ৰত্বে অপার ।
ইন্দ্রিয় শােষক শােকে অশান্তিই সার।।৮
সঞ্জয় কহিলেন
হৃষীকেশে এই বাক্য বলিয়া অৰ্জুন।
“করিব না যুদ্ধ” বলি মৌনভাবে রন।।৯
কহিলেন হৃষীকেশ বিষন্ন অর্জুনে।
উভয় সেনার মধ্যে প্রসন্ন বদনে।।১০
সরলার্থঃ অজ্ঞান আমি কুলানাশের ভয়ে ভীত । আমি তােমার শিষ্য ও শরণাপন্ন। আমাকে বিহিত উপদেশ দাও।৭ নিষ্কন্টক রাজ্য কিংবা স্বর্গের রাজত্ব পাইলেও আমার শান্তির পরিবর্তে অশান্তিই ঘটিবে ।৮ সঞ্জয় বলিলেন—শ্রীকৃষ্ণকে এই কথা বলিয়া অর্জুন কহিলেন আমি যুদ্ধ করিব না” বলিয়া তিনি চুপ করিয়া রহিলেন।৯ তখন সৈন্যদলের দুইপক্ষের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ বিষণ্ন অর্জুনকে প্রসন্নবদনে বলিলেন ।১০
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন
অশৌচ্যের তরে শােক নাহি মুখে প্রজ্ঞাবাণী।
মৃতে বা জীবিতে শােক নাহি করে জ্ঞানী ।।১১
আমি তুমি রাজাগণ পূর্বেতেও ছিনু ।
আছি ও থাকিব সবে তােমাকে কহিনু।।১২
কৌমার যৌবন জরা যথা দেহে আসে।
তথা মৃত্যু, জ্ঞানী তাহে শােক না প্রকাশে ৷ ৷১৩
সরলার্থঃ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন—হে অর্জুন, যাহাদের জন্য শােক করা উচিত নয় তুমি তাহাদের জন্যই শােক করিতেছ; অথচ জ্ঞানীর মত কথা বলিতেছ। জ্ঞানী ব্যক্তি মৃত বা জীবিতের জন্য কখনও শোক করেন না। ১১ এই রাজগণ, তুমি ও আমি-আমরা সকলেই পূর্বে ছিলাম, এখনও আছি, পরেও থাকিব ।১২ মানুষের দেহে শৈশব, যৌবন ও বার্ধক্য যেভাবে আসে মৃত্যুও সেইভাবে আসে। জ্ঞানী ব্যক্তি তাহাতে শোক করেন না। ১৩
শীত, তাপ, সুখ, দুঃখ মাত্ৰাস্পর্শে হয় ।
নিত্য নয়, সহ তাহা ভরত তনয়।।১৪
সুখ দুঃখে সম জ্ঞান করে যেই জন ।
অমরত্ব লভে সেই শুন হে অর্জুন ৷ ৷১৫
নিত্যের বিনাশ নাই অনিত্য বিনাশী ।
উভয়ের অন্ত জানে শুধু তত্ত্বদর্শী ৷ ৷১৬
অবিনাশী সর্বব্যাপী অব্যয় আত্মার ।
বিনাশ করিতে পারে হেন সাধ্য কার।।১৭
সরলার্থঃ শীত, উষ্ণ, সুখ-দুঃখ, প্রভৃতি বিষয়জনিত ও অনিত্য। ইহারা আসে এবং যায়। হে অর্জুন, তুমি এই সব সহ্য কর ।১৪ যে ব্যক্তি, এই সকলে বিচলিত হয় না, তিনি মােক্ষ লাভ করিতে পারেন।১৫ অসৎ বস্তু স্থায়ী হয় না। স্থায়ী বস্তু বিনষ্ট হয় না। জ্ঞানী ব্যক্তি এই তত্ত্ব অবগত থাকেন।১৬ আত্মা অবিনাশী ও সর্বব্যাপী কেহই ইহার বিনাশ করিতে পারে না।১৭
এ দেহ অনিত্য কিন্তু আত্মা নিত্য ধন।
অতএব কর যুদ্ধ ভরতনন্দন ।।১৮
হত্যা করে এই আত্মা কিংবা হত হয়।
যে বলে সে নাহি জানে আত্মা সর্বময়।।১৯
জন্ম-মৃত্যু নাহি তার নাহি বুদ্ধি ক্ষয়।
শরীর নাশেও আত্মা অবিনাশী রয়।।২০
নিত্য অবিনাশী জানে যে জন আত্মায়।
হত্যা করে সে কাহারে কারে বা করায় ।।২১
সরলার্থঃ দেহ অনিত্য কিন্তু আত্মা নিত্য। হে অর্জুন, ইহা স্মরণ রাখিয়া তুমি যুদ্ধ কর ।১৮ যে ব্যক্তি বলে যে, আত্মহত্যা করেন কিংবা হত হন, আত্মা যে সর্বব্যাপী তাহা সে জানে না। ১৯ আত্মার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, ক্ষয় নাই বৃদ্ধি নাই । শরীর নষ্ট হইলেও আত্মা নষ্ট হয় না।২০ যে ব্যক্তি আত্মাকে অবিনাশী বলিয়া জানে, সে ব্যক্তি কাহাকেও হত্যা করিতে বা হত্যা করাইতে পারে না। ২১
জীর্ণ বস্ত্র ছাড়ি নর নব বস্ত্র পরে।
জীর্ণ দেহ ছাড়ি আত্মা নব দেহ ধরে ।।২২
অস্ত্রে নাহি কাটে তারে না পােড়ে অনলে।
পবন করে না শুষ্ক, না ভিজে সলিলে ৷ ৷২৩
ছিন্ন দগ্ধ সিক্ত শুষ্ক কভু নাহি হয়।
অচল অব্যয় আত্মা নিত্য সর্বময়।।২৪
সরলার্থঃ মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র ত্যাগ করিয়া নূতন বস্ত্র পরিধান করে, আত্মাও সেইরূপ জীর্ণ শরীর ত্যাগ করিয়া নূতন শরীর গ্রহণ করে।২২ আত্মাকে কোনো অস্ত্র দিয়া কাটা যায় না, আগুন দিয়ে পােড়ান যায় না, বাতাসে শুকান যায় না, জল দিয়ে ভিজান যায় না।২৩ এই আত্মা কখনও সিক্ত, ছিন্ন, দগ্ধ, এবং শুষ্ক হয় না। এই আত্মা সর্বব্যাপী, অচল, স্থির এবং সনাতন। ২৪
অব্যক্ত অচিন্ত্য নিত্য আত্মা নির্বিকার।
তার তরে শােক কভু সাজে না তােমার।।২৫
নিত্য জন্মে মরে আত্মা এও যদি জান।
তবু তার তরে শােক নহে যােগ্য হেন।। ২৬
জন্মিলে মরিতে হয় মলে জন্ম হবে।
অনিবার্য এই কার্য, শােক কেন তবে।।২৭
আদিতে অব্যক্ত জীব অব্যক্ত অন্তেতে।
মধ্যে মাত্র ব্যক্ত হয় শােক কেন তবে।।২৮
সরলার্থঃ অতএব অব্যক্ত, অচিন্ত্য, নিত্য ও নির্বিকার আত্মার জন্য শোক করা তােমার উচিত নয়।২৫ আর তুমি যদি মনে কর যে, আত্মা দেহের সাথে জন্মে ও দেহের সঙ্গে বিনষ্ট হয়, তবুও আত্মার জন্য শােক করা তােমার উচিত নয় ।২৬ জন্মের পর মৃত্যু, মৃত্যুর পর জন্ম—ইহা নিশ্চিত। ইহা জানিয়াও তােমার শােক করা উচিত নয় ।২৭ জীবগন আদিতে ও বিনাশে অপ্রকাশিত। তাছাড়া মধ্যে প্রকাশিত । ইহাতে শােকের কিছু নাই। ২৮
কেহ দেখে কেহ কহে আশ্চর্য আত্মায়।
কেহ শুনে শুনিয়াও বুঝেনা আমায়।।২৯
সর্বদেহে এই আত্মা অবধ্যই রয়।
কারাে তরে শােক করা উচিত না হয়। । ৩০
স্বধর্ম দেখিয়া বীর ভীত না হইবে।
ধর্মযুদ্ধ করি ক্ষত্র কল্যাণ পাইবে।।৩১
অযাচিত হেন যুদ্ধ ভাগ্যে থাকে যার ।
সেই সুখী তার তরে মুক্ত স্বর্গদ্বার।।৩২
সরলার্থঃ আত্মা কিরূপ তাহা বুঝা সহজ নয়। সকলের নিকটই আত্মা আশ্চর্য কিছু।২৯ আত্মা প্রতি শরীরেই অবস্থিত আছেন। তিনি অবধ্য অতএব কাহারও জন্যই শােক করা উচিত নয় ।৩০ ধর্মের কথা চিন্তা করিয়া তােমার ভীত হওয়া উচিত নয়। কারণ ধর্মযুদ্ধের চেয়ে ক্ষত্রিয়ের কল্যাণকর আর কিছু নাই ।৩১ যে ক্ষত্রিয় এইরূপ ধর্মযুদ্ধ করিয়া থাকেন, তিনি ভাগ্যবান, তিনি মুক্ত । তিনি স্বর্গ লাভ করিয়া থাকেন।৩২
নাহি যদি কর এই ধর্মযুদ্ধ তবে।
স্বধর্ম ও কীর্তি ছাড়ি পাপভাগী হবে।।৩৩
অকীর্তি তখন তব রটিবে জগতে।
মানীর মরণ শ্রেয়ঃ অপযশ হতে।।৩৪
সম্মান করিতে যারা সেই বীরগণ।
ভীরু বলি উপহাস করিবে তখন।।৩৫
কত নিন্দা শত্রুগণ করিবে তােমার।
এর চেয়ে কিবা দুঃখ হতে পারে আর।।৩৬
সরলার্থঃ তুমি যদি এই ধর্মযুদ্ধ না কর তবে তােমার স্বধর্ম ও কীর্তি নষ্ট হইবে, তােমার পাপ হইবে ।৩৩ তখন তােমার দুর্নাম হইবে। দুর্নাম অপেক্ষা মানীর মৃত্যু শ্রেয়ঃ। ৩৪ যে সকল বীর এখন তােমাকে সম্মান করে তাহারাই তখন ভীরু, কাপুরুষ— এই বলিয়া তােমাকে উপহাস করিবে ।৩৫ শত্রুগণও তখন তােমার নিন্দা করিবে। ইহা অপেক্ষা দুঃখের আর কি আছে?৩৬
হত হলে স্বর্গলাভ রাজ্যলাভ জয়ে।
তাই যুদ্ধ কর পার্থ দৃঢ়চিত্ত হয়ে।।৩৭
সুখদুঃখ লাভালাভ জয়-পরাজয় ।
সম জানি কর যুদ্ধ নাহি পাপ ভয়।।৩৮
সাংখ্যতত্ত্ব কহিলাম, শুন কর্মযােগ ।
এতে নিষ্ঠ হলে পার্থ যাবে কর্মভােগ ।।৩৯
নিষ্কাম কর্মতে নাহি কোন প্রত্যবায়।
এ ধর্মের অল্পেতেই মহাভয় যায় ।।৪০
সরলার্থঃ এই ধর্মযুদ্ধে যদি তােমার মৃত্যু হয় তবে তুমি স্বর্গ পাইবে, আর এই যুদ্ধে যদি জয়লাভ কর তবে তুমি পৃথিবী ভােগ করিবে। অতএব হে অর্জুন, যুদ্ধের জন্য কৃতসংস্কল্প হও। ৩৭ সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ ও জয়-পরাজয় সমান মনে করিয়া তুমি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।৩৮ এতক্ষণ তােমাকে আত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে বলিলাম। এখন নিষ্কাম কর্ম সম্বন্ধে বলিতেছি, শ্রবণ কর।৩৯ নিষ্কাম কর্ম কখনও নিষ্ফল হয় না, যতটুকু করা যায় ততটুকুই সার্থক হয় ।৪০
স্থির বুদ্ধি কখনও এক ভিন্ন নয়।
অনিশ্চিত বুদ্ধি পার্থ বহু শাখাময়।।৪১
বেদবাদী করে কর্ম সকাম প্রচার।
তাঁর মতে অন্য কিছু নাই করিবার।।৪২
স্বর্গলাভ তরে তারা কত কিছু করে।
জন্ম কর্মফল লভে ক্রিয়ার ভিতরে।।৪৩
এভাবে যাহারা সদা হেন ভােগ চায় ।
বণিক তাহারা, কভু সমাধি না পায় ৷ ৷৪৪
সরলার্থঃ হে অর্জুন, নিষ্কাম কর্মী স্থিরচিত্ত, একনিষ্ঠ। আর সকামকৰ্মী অস্থিরচিত্ত । তাহার কামানাও বহু।৪১ বেদোক্ত কর্মসকল সকাম কর্ম। বেদে সকাম কর্ম ভিন্ন অন্য কিছু করিবার নাই ।৪২ বেদোক্ত কর্মের লক্ষ্য স্বর্গপ্রাপ্তি । বেদবাদী তাহার কর্মের দ্বারা পুনর্জন্ম লাভ করিয়া থাকেন ।৪৩ বৈদিক কর্মকারীর কাম্য কেবল ভােগ, তাই বৈদিক কর্ম করিয়া কেহ ব্রহ্মে একনিষ্ঠ হইতে পারে না ।৪৪
ত্রিগুণ বিষয় বেদ গুণাতীত নয় ।
গুণাতীত হও তুমি কুন্তীর তনয়।।৪৫
প্লাবিত অঞ্চলে নাই কূপে প্রয়ােজন।
ব্রহ্মজ্ঞানী নাহী করে বেদে আকিঞ্চন।।৪৬
কর্মে তব অধিকার কর্ম ফলে নয়।
ফল আশা, ত্যাগ কর, কর্ম যেন রয়।।৪৭
আসক্তি ছাড়িয়া কর কর্মের উদ্যোগ।
ফলাফলে সম জ্ঞান সমত্বই যােগ।।৪৮
সরলার্থঃ বেদ ত্রিগুণবিষয়ক হে অর্জুন, তুমি গুণাতীত নিষ্কাম, শীতােষ্ণ বােধহীন, কামনাশূন্য হও।৪৫
টীকাঃ ত্রিগুণবিষয়ক— আসক্তিমূলক, সকাম গুণাতীত— আসক্তিহীন নিষ্কাম ।
জলপূর্ণ স্থানে কূপের প্রয়ােজন হয় না। সেইরূপ ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তিরও বেদের প্রয়ােজন নাই।৪৬ কর্মেই তােমার অধিকার, কর্মফলে অধিকার নাই ।৪৭ অতএব কর্মফলের আশা না করিয়া তুমি কর্ম করিয়া যাও। ফলাফলে সমজ্ঞানই যােগ।৪৮
নিকৃষ্ট সকাম কর্ম, জ্ঞানযােগ সার।
ফলকামী জন ঘৃণ্য কুন্তীর কুমার।।৪৯
এ জগতে জ্ঞানী হয় পাপপুণ্য-ত্যাগী।
কর্মের কৌশল যােগ, তাই হও যােগী।।৫০
জ্ঞানীগণ কর্মফল কখনাে না চান।
কর্মবন্ধ যুক্ত হয়ে, তাঁরা মােক্ষ পান ৷ ৷৫১
কাটিয়া মােহের ঘাের, বুদ্ধি স্থির যবে।
বাসনা হইয়া লয় মন স্থির হবে।।৫২
সরলার্থঃ সকাম কর্ম নিকৃষ্ট, নিস্কাম কর্ম শ্রেষ্ঠ। হে অর্জুন, যে ব্যক্তি ফলের আকাঙ্ক্ষায় কর্ম করে সে নিকৃষ্ট। ৪৯ জ্ঞানী ব্যক্তি পাপপুণ্য ত্যাগী। কর্মের কৌশলকেই যােগ বলে। হে অর্জুন, তুমি যােগী হও।৫০ জ্ঞানীগণ কখনও কর্মফল চান না, তাঁহারা কর্মের বন্ধন হইতে মুক্তি লাভ করেন ।৫১ নিষ্কাম কর্ম করিতে করিতে বাসনা দূর হইবে। বাসনা দূর হইলে মন স্থির হইবে।৫২
বেদবাক্য ত্যজি যবে হবে স্থির ভাব।
অভ্যাসের দ্বারা তব হবে যােগ লাভ।।৫৩
অর্জুন কহিলেন
সমাধিস্থ স্থিরবুদ্ধি কি কহে কেশব ।
ভাব স্থিতি গতি তাঁর কহ মােরে সব।।৫৪
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন
মনের বাসনা রাশি করিয়া বর্জন।
আনন্দে থেকে যােগী স্থিরবুদ্ধি হন ৷ ৷৫৫
দুঃখে স্থির, সুখেতেও স্পৃহাহীন যিনি ।
রােগ-ভয় ক্রোধশূন্য স্থিরবুদ্ধি তিনি।।৫৬
সরলার্থঃ নিষ্কাম কর্মের দ্বারা যখন তােমার মন স্থির হইবে তখনই অভ্যাস বশে তােমার যােগ লাভ হইবে।৫৩ অর্জুন বলিলেন-হে কৃষ্ণ, স্থিরবুদ্ধি ব্যক্তি বলিতে কাহাকে বুঝায়? তাহার লক্ষণ কি? সে কিরূপ কার্যাদি করে?৫৪ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন-যিনি সমস্ত কামনা-বাসনা ত্যাগ করিয়া সর্বদা সন্তুষ্ট থাকেন তিনিই স্থিরবুদ্ধি।৫৫ যিনি সুখ দুঃখ, ভয় ক্রোধ কিছুতেই বিচলিত হন না তিনিই স্থিরবুদ্ধি ।৫৬
শুভাশুভে চিত্ত যার তুষ্ট-রুষ্ট নয়।
অনাসক্ত এই জনে স্থিরবুদ্ধি কয়।।৫৭
কূর্মবৎ সংকুচিত নিজ অঙ্গ যার।
সংযত ইন্দ্রিয় সেই, স্থিরবুদ্ধি তার।।৫৮
নিরাহারে ভােগ নাই, স্পৃহা কিন্তু হয়।
পরমে দেখিয়া তার, স্পৃহা দূরে যায়।।৫৯
দুর্জয় ইন্দ্রিয়চয় কুন্তীর নন্দন।
সবলে হরিয়া লয় বিবেকীর মন।।৬০
সরলার্থঃ যিনি শুভ ও অশুভ কিছুতেই বিচলিত হন না, এবং যিনি আসক্তিশূন্য তিনিই স্থিরবুদ্ধি।৫৭ যিনি কচ্ছপের মত নিজের ইন্দ্রিয়গণকে সংকুচিত করিয়া রাখেন, সেই সংযত ব্যক্তিই স্থিরবুদ্ধি।৫৮ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা বিষয় ভােগ না করিলেই বিষয় তৃষ্ণা দূর হয় না । পরম পুরুষকে দেখিয়া যাঁহার বিষয় বাসনা দূর হয়, তিনিই স্থিরবুদ্ধি ব্যক্তি। ৫৯ হে অর্জুন, ইন্দ্রয়গণকে জয় করা সহজ নয়। তাহারা সকলে বিবেকী ব্যক্তির চিত্তকে বিষয়ে আকৃষ্ট করে। ৬০
মৎপর হইয়া কর ইন্দ্রিয় দমন।
স্থিরবুদ্ধি হয়ে থাকে জিতেন্দ্রিয় জন ।।৬১
বিষয় চিন্তনে জীবে আসক্তি জন্মায়।
আসক্তি হইতে কাম, কামে ক্রোধ পায়। । ৬২
ক্রোধ হতে জন্মে মােহ, মােহে স্মৃতি নাশ ।
স্মৃতিনাশে বুদ্ধিনাশ, ঘটে যে বিনাশ ।।৬৩
নিস্পৃহ বিদ্বেষহীন আত্মবশী জন ।
বিষয়ে থেকেও লভে আত্মপ্রসাদন।।৬৪
সরলার্থঃ মৎপরায়ণ হইয়া ইন্দ্রিয় সংযম কর। জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিই স্থিরবুদ্ধি হইয়া থাকেন ।৬১ বিষয়ের চিন্তা করিলে আসক্তি জন্মে। আসক্তি হইতে কাম, কাম হইতে ক্রোধ জন্মে।৬২ ক্রোধ হইতে মােহ জন্মে। মােহ হইতে স্মৃতিনাশ হয় । স্মৃতিনাশ হইলে বুদ্ধিনাশ হয়। বুদ্ধি নাশ হইলে বিনাশ ঘটে।৬৩ জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি বিষয়ে থাকিয়াও আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়া থাকেন ।৬৪
চিত্তের প্রসাদে হয় সর্বদুঃখ নাশ ।
সুপ্রসন্ন চিত্তে স্থিরবুদ্ধির প্রকাশ ।। ৬৫
অসংযতে বুদ্ধি নাই শান্তিহীনে ধ্যান।
ধ্যান বিনা শান্তি নাই সুখ শান্তিহীনে।।৬৬
সমুদ্রে ডুবায় তরী বাতাস যেমন।
সেইরূপ ইন্দ্রিয় হরি’লয় তার মন।।৬৭
বিষয় হইতে মন নিগৃহীত যার।
প্রতিষ্ঠিত হয় বীর স্থির বুদ্ধি তার।। ৬৮
সরলার্থঃ আত্মপ্রসাদ লাভ হইলে সকল দুঃখ দূর হয়। দুঃখ দূর হইলে স্থিরবুদ্ধি প্রকাশিত হয় । ৬৫ যাহার চিত্ত সংযত এবং চিত্ত প্রসন্ন নয়, তাহার সুখ শান্তি লাভ হয় না । ৬৬ বাতাস যেমন সমুদ্রে নৌকা ডুবাইয়া দেয়, সেইরূপ ইন্দ্রিয়গণও অসংযত ব্যক্তির মন হরণ করিয়া থাকে। ৬৭ ইন্দ্রিয়গণ সর্বপ্রকার বিষয় হইতে নিবৃত্ত হইলেই মন স্থির হয় ।৬৮
আত্মদর্শী যােগী জাগে জীব সুপ্ত যাতে ।
বিষয়ে নিদ্রিত যােগী জীব জাগে তাতে।।৬৯
যত নদী প্রবেশয়ে অব্ধি স্থির রয় ।
সর্ব কামে যােগী স্থির কামী শান্ত নয়।।৭০
কামনা ছাড়িয়া যেবা বিষয়ে বিচারে।
নিঃস্পৃহ নিৰ্দ্বন্দ সে ই শান্তি লাভ করে।।৭১
এই ব্রহ্মজ্ঞান, পার্থ ইথে নিষ্ঠা যার।
মােহ যায়, অন্তিমেতে মিলে মােক্ষ তার।।৭২
সরলার্থঃ আত্মদর্শী ব্যক্তি যাহাতে জাগ্রত থাকেন, বিষয়ী ব্যক্তি তাহাতে নিদ্রিত থাকে। বিষয়ী ব্যক্তি যাহাতে নিদ্রিত থাকে, আত্ত্বদর্শী ব্যক্তি তাহাতে জাগ্রত থাকেন ।৬৯ সমুদ্র মধ্যে যত নদীই প্রবেশ করুক না কেন সমুদ্র স্থিরই থাকে। সেই যােগী ব্যক্তি সকল কামনার মধ্যেও স্থির থাকেন, কিন্তু কামনাপরায়ণ ব্যক্তি স্থির থাকিতে পারে না।৭০ যিনি কামনা ত্যাগ করেন, তিনি নিঃস্পৃহ। নিঃস্পৃহ ব্যক্তি শান্তি লাভ করেন।৭১ হে অর্জুন, ইহাই ব্রাহ্মীস্থিতি (অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানে অবস্থান)। এই অবস্থা প্রাপ্তিতে মােহ দূর হইয়া মােক্ষ লাভ হয়।৭২
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের সার-সংক্ষেপ
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে বিপক্ষের সৈন্যদলে গুরুজন ও আত্মীয়স্বজনদিগকে দেখিয়া অর্জুন শােকাকুল হইলেন। স্থির করিলেন, তিনি গুরুজন ও আত্মীয় স্বজনদের বধ করিবেন না। শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন–অর্জুনের এই শােক অজ্ঞানতা- মুলক। ইহা দূর করিবার জন্য তিনি অর্জুনকে আত্মতত্ত্ব ও কর্মযােগ সম্বন্ধে উপদেশ দিলেন। শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন- অর্জুন, তুমি বুঝিয়াও বুঝিতেছ না। তাই শােক করিতেছ। যুদ্ধ করিলে আত্মীয়- স্বজনগণকে বধ করিতে হইবে-এই ত তােমার শােকের প্রধান কারণ। আচ্ছা, বধ করিবে কাহাকে? প্রত্যেকটি লােকের দেহ আছে, আর সেই দেহের ভিতরে আত্মা আছেন। আত্মার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, ক্ষয় নাই, বিনাশ নাই । আত্মাকে আগুনে পােড়ানাে যায় না, জলে ভিজানাে যায় না, রৌদ্রে শুকানাে যায় না, অস্ত্র দিয়া কাটা যায় না, বাতাসে উড়ানাে যায় না। আত্মা নিত্য অবিনাশী ও সর্বব্যাপী ।
আত্মাকে কেহ হত্যা করিতে পারে না আত্মাও কাহাকে হত্যা করেন না। মানুষ মরিলে বা মানুষ হত্যা করিলেই তাহার শরীরটা নষ্ট হয়, আত্মা নষ্ট হন না; আত্মা অন্য দেহ গ্রহণ করেন। মানুষ ছেড়া কাপড় ত্যাগ করিয়া নূতন কাপড় পরে। আত্মাও সেইরূপ জীর্ণ শরীর পরিত্যাগ করিয়া একটা নূতন শরীর গ্রহণ করেন মাত্র । ইহা জন্মান্তর বা পুনর্জন্ম । জন্মান্তর বা পুনর্জন্মে আত্মা ঠিকই থাকেন, পরিবর্তন হয় শুধু দেহটার। দেহ নশ্বর। ইহার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী। আত্মা নিত্য বলিয়াই তােমার আত্মীয়স্বজনগণ, তুমি আমি-সকলেই পূর্ব জন্মে ছিলাম, এ জন্মে আছি এবং পরজন্মেও থাকিব । পূর্বজন্ম ও পরজন্মের বৃত্তান্ত সকলে বুঝিতে পারে না। বর্তমান জন্মের কথা কিন্তু সকলেই বুঝিতে পারে। এইজন্য আত্মার স্বরূপ কেহই বুঝিতে পারে না। সকলেই আত্মাকে আশ্চর্য কিছু মনে করে । ইহাই আত্মতত্ত্ব । দেহ নশ্বর ও আত্মা অবিনাশী । ইহাই আত্মতত্ত্বের মূল কথা ।
এখন তােমাকে কর্মযােগ সম্বন্ধে বলিতেছি, শােন। কর্মযােগ অর্থ স্বধর্ম পালন। স্বধর্ম পালন কর্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। কোন্ কর্ম করিলে পাপ হয়, আবার কোন কর্ম করিলে পাপ হয় না—ইহা জানিয়া কর্ম করিলেই সুষ্ঠুভাবে স্বধর্ম পালন করা যায়, কর্মযােগ সুসম্পন্ন হয়। কর্ম দুই প্রকার—সকাম ও নিষ্কাম। ফল লাভের আশায় যে কর্ম তাহা সকাম কর্ম । আর ফল লাভের আশা না করিয়া যে কর্ম করা হয় তাহা নিষ্কাম কর্ম। সকাম কর্ম করিয়া কর্মফল অবশ্যই ভােগ করিতে হইবে । কিন্তু নিষ্কাম কর্ম করিলে কর্মফল ভােগ করিতে হয় না। সকাম কর্ম কাম্য কর্ম । বেদোক্ত কর্ম সকাম কর্ম । ইহা কামনা-বাসনা পরিপূর্ণ। কাম্য কর্মের লাভ-অলাভ জয়-পরাজয়, পাপ-পুণ্য প্রভৃতি নানাফল। নিষ্কাম কর্মের দ্বারা কামনা-বাসনা দূর হয়, সংযম লাভ হয়, পরমেশ্বরে মনপ্রাণ সমাহিত হয়। পরমেশ্বরে মনপ্রাণ সমাহিত হইলে বুদ্ধি স্থির হয়। জিতেন্দ্রিয় স্থিরবুদ্ধি ব্যক্তি কর্ম করিয়াও কর্মে আবদ্ধ হন না। কেননা, তাহার কোনরূপ কামনা-বাসনা নাই।
মৃত্যুর পর তিনি মুক্তি লাভ করেন। সকাম কর্ম করা হয় নিজের স্বার্থে। কিন্তু নিষ্কাম কর্ম করা হয় পরার্থে—ভগবানের সৃষ্টি রক্ষার জন্য । ফলের আকাক্ষা ত্যাগ করিয়া, তুমি ভগবানের কাজটি করিতেছ মাত্র এবং ভগবানই কাজের ফলাফল পাইবেন— এই ভাবিয়া নিষ্কাম কর্ম করিতে হয় । অতএব হে অর্জুন, তুমি উঠ। রাজ্যলাত ও সুখভােগের আশা ত্যাগ করিয়া ভগবানের সৃষ্টি রক্ষার জন্য যুদ্ধ কর। তখন যুদ্ধে লােক হত্যা করিলেও তোমার পাপ হইবে না। তুমি ক্ষত্রিয়। যুদ্ধ করা ত ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য। যুদ্ধে জয় হইলে রাজ্য পাইবে। মৃত্যু হইলে স্বর্গ লাভ হইবে। তুমি যদি যুদ্ধ না-ই কর তবে বিপক্ষীয়েরা তােমাকে উপহাস করিবে, তােমার দুর্নাম রটাইবে। মানী ব্যক্তির দুর্নাম অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয়ঃ।
ইতি সাংখ্যযোগ নামক দ্বিতীয় অধ্যায়।
আরো পড়ুন:
মঙ্গলাচরণ | প্রথম অধ্যায় | তৃতীয় অধ্যায় | চতুর্থ অধ্যায় | পঞ্চম অধ্যায় | ষষ্ঠ অধ্যায় | সপ্তম অধ্যায় | অষ্টম অধ্যায় | নবম অধ্যায় | দশম অধ্যায় | একাদশ অধ্যায় | দ্বাদশ অধ্যায় | ত্রয়োদশ অধ্যায় | চতুর্দশ অধ্যায় | পঞ্চদশ অধ্যায় | ষােড়শ অধ্যায় | সপ্তদশ অধ্যায় | অষ্টাদশ অধ্যায় | সংক্ষিপ্ত-মাহাত্ম্যম | সম্পূর্ণ-মাহাত্ম্যম | ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র।
0 মন্তব্যসমূহ