Chapter-14 বাংলায় শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার চতুর্দশ অধ্যায় | Fourteenth Chapter of Srimad Bhagavad Gita in Bengali

Chapter-14 বাংলায় শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার চতুর্দশ অধ্যায় | Fourteenth Chapter of Srimad Bhagavad Gita in Bengali


চতুর্দশ অধ্যায়


গুণত্রয়-বিভাগযােগ


শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন

সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান আমি বলিব তােমায়।

যাহা জানি মুনি-ঋষি পরাগতি পায়।।১

এ জ্ঞান আশ্রয়ে যারা মাের ভাব পেয়ে।

জন্মে না সৃষ্টিতে দুঃখ পায় না প্রলয়ে ৷ ৷২

মহৎ-ব্রহ্ম হয় মাের গর্ভাধান স্থান ।

ব্রহ্মাদি সকল ভূত তাহে জন্ম পান।।৩

সরলার্থঃ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন– হে অর্জুন, যে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান জানিয়া মুনি-ঋষিগণ মােক্ষলাভ করেন তাহা আমি তােমাকে এখন বলিব। ১ এই জ্ঞানের বলে জ্ঞানী ব্যক্তি পুনর্জন্ম গ্রহণ করেন না, প্রলয়কালেও দুঃখ ভােগ করেন না। ২ মহৎ ব্রহ্ম আমার গর্ভাধান স্থান। ব্রহ্মাদি সকল প্রাণী তাহাতে জন্মলাভ করে। ৩


দেখিতেছ যত সৃষ্টি মৎ ব্রহ্ম মাতা।

আমি পার্থ তাহাদের বীজপ্রদ পিতা।।৪

প্রকৃতির সত্ত্ব রজঃ তমঃ গুণত্রয় ।

অব্যয় দেহীকে দেহে মােহে বাঁধি লয়।।৫

সুনির্মল সত্ত্ব পার্থ শান্তদীপ্ত রহে।

সুখসঙ্গে জ্ঞানসঙ্গে আত্মা থাকে দেহে।।৬

তৃষ্ণা হতে জন্মি রজঃ আসক্তি জন্মায়।

দেহীকে দেহে বান্ধে কর্ম-কামনায়।।৭

সরলার্থঃ হে অর্জুন। মহৎ ব্রহ্ম সকল সৃষ্টির মাতা। আর আমি তাহাদের পিতা। ৪ প্রকৃতির তিনটি গুণ— সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ । এই তিন গুণ অব্যয় দেহীকে দেহে বদ্ধ করে। ৫ হে অর্জুন, এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ অতি পবিত্র গুণ। এই গুণের বলে আত্মা বেশ ভাল ভাবেই দেহে অবস্থান করেন। ৬ কামনা-বাসনা হইতে রজোগুণ জন্মে। এই গুণ মানুষকে কাজে প্রবৃত্ত করিয়া বদ্ধ করে। ৭


অজ্ঞানতাজাত তমােগুণ মােহের কারণ।

নিদ্রালস্য মােহে করে জীবেরে বন্ধন।।৮

সত্ত্বে সুখ ঘটে রজে কর্মের প্রয়াস।

তমেতে প্রমাদ ঘটে করি বুদ্ধিনাশ।।৯

রজঃ তমঃ হতে কারাে সত্ত্ব বলী হয়।

কারে রজঃ কাহারে বা তমঃ আগে রয়।।১০

সর্বদেহময় যবে জ্ঞান উপজীবে ।

তখন এই সত্ত্বগুণ বর্ধিত হইবে।।১১

সরলার্থঃ অজ্ঞানতা হইতে তমােগুণের উৎপত্তি। এই গুণের প্রভাবে মােহ-ঘটিয়া থাকে । ৮ সত্ত্ব গুণে সুখ লাভ হয়। রজোগুণে কাজে আসক্তি বাড়ে। তমােগুণে বুদ্ধিনাশ হয় ও প্রমাদ ঘটে। ৯ এই গুণের মধ্যে কাহারও সত্ত্বগুণ প্রধান হয়, কাহারও রজোগুণ প্রধান হয়, কাহারাে তমােগুণ প্রধান হয়। ১০ সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি পাইলে নির্মল জ্ঞান উৎপন্ন হয়। ১১


লােভ ক্ষোভ স্পৃহা আদি উদয় যখন।

জানিবে যে রজোগুণ বর্ধিত তখন।।১২

অপ্রবৃত্তি ভ্রম কিংবা মােহ অপ্রকাশ।

বৃদ্ধি পায় যথা তথা তমঃ করে বাস।।১৩

সত্ত্ব বৃদ্ধিকালে পার্থ মৃত্যু হয় যার ।

সুনির্মল দিব্যলােক লাভ হয় তার।।১৪

রজোবৃদ্ধি কালে মরি নরলােকে যায়।

তমােবৃদ্ধি কালে মরি পশুযোনি পায়।।১৫

সরলার্থঃ রজোগুণ বৃদ্ধি পাইলে লােভ, ক্ষোভ, স্পৃহা প্রভৃতি জন্মিয়া থাকে। ১২ তমােগুণ বৃদ্ধি পাইলে বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞান লােপ পায়। ১৩ যে সময় সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় সেই সময় যাহাদের মৃত্যু হয় তাহারা দিব্য লােক লাভ করে। ১৪ রজো বৃদ্ধি কালে মরিলে নরলােকে যায় এবং তমােবৃদ্ধি কালে মরিলে পশু-যােনি প্রাপ্ত হয়। ১৫


সাত্ত্বিক কর্মের ফল সুখ সুনির্মল ।

রজে দুঃখ তমােগুণে অজ্ঞানতা ফল।।১৬

সত্ত্বগুণে জ্ঞানলাভ লােভ রজোগুণে।

তমােগুণ মােহ আদি অজ্ঞানতা আনে।।১৭

সত্ত্বে পায় স্বর্গলােক রজে নরলােক পায় ।

হীনবৃত্তি তমােগুণে অধঃপাতে যায়।।১৮

এই গুণত্রয় জানি সর্বকর্মে কর্তা।

মম ভাবে থাকে সদা গুণাতীত আত্মা।১৯

সরলার্থঃ সত্ত্বগুণের ফলে সুখ; রজোগুণের ফলে দুঃখ এবং তমােগুণের ফলে অজ্ঞানতা প্রাপ্ত হয়। ১৬ সত্ত্বগুণে জ্ঞান লাভ, রজোগুণে লােভ এবং তমােগুণে মােহ প্রভৃতি জন্মে। ১৭ সত্ত্বগুণের ফলে স্বর্গলােক প্রাপ্ত হয়, রজোগুণের ফলে নরলােক প্রাপ্ত হয় এবং তমােগুণের ফলে অধঃপতন ঘটে। ১৮ যখন দ্রষ্টা জীবগুণ ভিন্ন অন্যকে কর্তা দেখেন না, এবং তিনগুণের অতীত পরমাত্মাকে জানতে পারেন, তখন তিনি আমার স্বরূপ লাভ করেন।১৯


দেহজাত ত্রিগুণেরে অতিক্রমি তবে।

জন্ম মৃত্যুজরা দুঃখে মুক্ত মােক্ষ লভে ৷ ৷২০

অর্জুন কহিলেন

কহ প্রভাে কিসে নর গুণাতীত হয়।

কি আচারে ত্রিগুণের অতীত সে রয়।।২১

শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন

জ্ঞানে কিংবা মােহে পাৰ্থ কিংবা কামনায়।

ইচ্ছা দ্বেষ মুক্ত ভাব গুণাতীত হয়।।২২

সরলার্থঃ এই তিনটি গুণ দেহ হইতে জাত। ইহাদিগকে অতিক্রম করিতে পারিলেই, জন্ম-মৃত্যু জরা-দুঃখ হইতে মুক্তি লাভ করিয়া মােক্ষ লাভ করে। ২০ অর্জুন বলিলেন—হে কৃষ্ণ, যেভাবে ত্রিগুণের অতীত হওয়া যায় তাহা আমাকে বল। ২১ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন— হে অর্জুন, জ্ঞান, মােহ বা কামনাবশত ইচ্ছা-দ্বেষ মুক্ত হইলেই গুণাতীত হওয়া যায়। ২২


স্বকর্মেতে লিপ্ত দেখি গুণে স্থির রন ।

গুণমধ্যে থাকি তিনি গুণাতীত হন।।২৩

স্বর্ণ লােষ্ট্রে সুখে দুঃখে যার সমজ্ঞান।

নিন্দা স্তুতি প্রিয়াপ্রিয়ে তুল্য ধীরজন।।২৪

মানে-অপমানে শত্রু-মিত্রে তুল্য যিনি।

সকল উদ্যম ত্যাগী গুণাতীত তিনি।।২৫

অনন্ত ভক্তিতে পার্থ মােরে সেবে যেই।

গুণাতীত হয়ে মােক্ষ ভাব পায় সেই ৷ ৷২৬

ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা আমি অমৃত অব্যয়।

শাশ্বত ও মূর্ত ধর্ম নিত্যানন্দময় ৷ ৷২৭

সরলার্থঃ যে ব্যক্তি ধীর-স্থিরভাবে নিজের কার্য করিয়া যান, তিনি গুণের মধ্যে থাকিয়াও গুণের অতীত ।২৩ স্বর্ণ-লােষ্ট্রে, সুখ-দুঃখে বা নিন্দা-স্তুতিতে ধীর ব্যক্তির সমজ্ঞান। ২৪ মান-অপমানে, শত্রু-মিত্রে যাঁহার সমজ্ঞান এবং যিনি উদ্যমত্যাগী, তিনিই গুণাতীত। ২৫ হে অর্জুন, যে ব্যক্তি ভক্তির সহিত আমার ভজনা করেন, সেই ব্যক্তি মােক্ষ লাভ করিয়া থাকেন। ২৬ ব্রহ্ম আমাতেই অবস্থিত। মুক্তির আশ্রয়ও আমি । আমার সেবা করিলেই মুক্তিলাভ হয়। ২৭


শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের সার-সংক্ষেপ

চতুর্দশ অধ্যায়ে ত্রিগুণ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে। প্রকৃতি হইতে সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ—এই তিনটি গুণ জন্মে । এই তিনটি গুণই ত্রিগুণ। মানুষ মাত্রই ত্রিগুণের অধীন। সত্ত্বগুণ প্রবল হইলে নির্মল জ্ঞান উৎপন্ন হয় । রজোগুণ প্রবল হইলে বিষয়-স্পৃহা, কর্মপ্রবৃত্তি, অস্থিরতা ইত্যাদি দেখা দেয়। তমােগুণ প্রবল হইলে উদ্যমহীনতা, কর্মের মােছ, ভ্রান্তি, বুদ্ধি বিপর্যয় প্রভৃতি দেখা দেয় । যিনি গুণের কার্য দ্বারা কখনও বিচলিত হন না, তিনিই হচ্ছেন ত্রিগুণাতীত। তাঁহার কাছে সকলই-সমান। এইভাবে ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়া সেই ব্যক্তি একসময় ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত-হন।

ইতি গুণত্রয়-বিভাগযােগ নামক চতুর্দশ-অধ্যায়।


আরো পড়ুন:

মঙ্গলাচরণ প্রথম অধ্যায় | দ্বিতীয় অধ্যায় | তৃতীয় অধ্যায় | চতুর্থ অধ্যায় | পঞ্চম অধ্যায় | ষষ্ঠ অধ্যায় | সপ্তম অধ্যায় | অষ্টম অধ্যায় | নবম অধ্যায় | দশম অধ্যায় | একাদশ অধ্যায় | দ্বাদশ অধ্যায় | ত্রয়োদশ অধ্যায় | পঞ্চদশ অধ্যায় | ষােড়শ অধ্যায় | সপ্তদশ অধ্যায় | অষ্টাদশ অধ্যায় | সংক্ষিপ্ত-মাহাত্ম্যম | সম্পূর্ণ-মাহাত্ম্যম | ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ