ষােড়শ অধ্যায়
দৈবাসুর সম্পদ বিভাগযােগ
শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন
অভয় সারল্য তুষ্টি তপঃ যজ্ঞ দান ।
দম আত্ম-জ্ঞানার্জন শাস্ত্র অধ্যয়ন।।১
অক্রোধ নিলাের্ভ লজ্জা সত্য সরলতা।
ত্যাগ দয়া শান্তি স্থৈর্য অক্রোধ নম্রতা।।২
ক্ষমা ধৈর্য তেজঃ শুদ্ধি অবিরােধ আর।
অমানিতা জেনাে দৈব সম্পদের সার।।৩
আসুর সম্পদ বলি অভিমান বােধ।
অজ্ঞানতা নিষ্ঠুরতা দম্ভ, দর্প, ক্রোধ।।৪
সরলার্থঃ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন— ভয়শূন্যতা, সরলতা, সন্তোষ, তপস্যা, যজ্ঞ, দান, দম, আক্রোধ, লােভশূন্যতা, লজ্জা, সত্য, ত্যাগ, শান্তি, স্থিরতা, শাস্ত্রপাঠ, নম্রতা, ক্ষমা, ধৈর্য, তেজঃ, শুদ্ধি, অবিরােধ, অমানিতা এই সকল দৈবভাব। ১-৩ ক্রোধ, দম্ভ, দর্প, অজ্ঞানতা, অভিমান এবং নিষ্ঠুরতা এইসব হল আসুর ভাব। ৪
মােক্ষ তরে দৈবভাব আসুরে বন্ধন।
অভিজাত তুমি পার্থ দুঃখ কি কারণ।।৫
দৈব ও আসুর জীবে দুই ভাব হয়।
দৈব বলেছি আসুর শুন ধনঞ্জয়।।৬
প্রবৃত্তি নিবৃত্তি কিছু জানে না অসুর।
সদাচার সত্য শুদ্ধি নাহিক তাহার।।৭.
ধর্মাধর্ম ঈশ্বর কভু মানে না তাহারা ।
স্ত্রী-পুরুষ সম্ভোগেই সৃষ্টি করে ধরা।।৮
সরলার্থঃ দৈব ভাব থাকলে মােক্ষলাভ হয় আর আসুর ভাব থাকলে বন্ধন ঘটে। হে অর্জুন, তুমিই শ্রেষ্ঠ-বংশজাত। এর পরেও তােমার এত দুঃখ কেন? ৫ জীবের দুইটি ভাব–দৈব ও আসুর। দৈব ভাবের কথা বলিয়াছি । আসুর ভাবের কথা বলিতেছি, শােন। ৬ অসুর প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জানে না; তাহার সদাচার, সত্য ও শুদ্ধি কিছুই নাই । ৭ অসুরেরা সত্য, ধর্ম ও ঈশ্বর মানে না। ভােগ বাসনার পরিতৃপ্তিই তাহাদের সব। ৮
হীন নষ্টমতি অল্প বুদ্ধি নরে।
বিশ্বমাঝে জন্মে পার্থ শুধু ধ্বংস তরে।।৯
কাম মােহ মদ মান দম্ভ দুরাশায়।
শুচিহীন হয়ে তারা দুরাগ্রহে ধায়। ৷১০
আমরণ কাম চিন্তা করে মূঢ় যারা।
কামভােগ ছাড়া কিছু জানে না তাহারা।।১১
শত আশাপাশে বদ্ধ সেই মূঢ়গণ।
ভােগ তরে করে তারা অর্থ উপার্জন ৷ ৷১২
সরলার্থঃ হে অর্জুন, অল্পবুদ্ধি মানব হীন দৃষ্টি ও মতিহীন হইয়া থাকে। ধ্বংসের জন্যই তাহারা পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করিয়া থাকে । ৯ তাহারা কাম, মদ, মান, দম্ভ ও শুচিহীন হইয়া দুরাগ্রহে ধাবিত হয়। ১০ যাহারা মূঢ় তাহারা আমরণ কাম চিন্তা করে। তাহারা কামভােগ ছাড়া আর কিছুই জানে না। ১১ সেই মূর্খ ব্যক্তিরা শত আশা-পাশে বদ্ধ থাকে। তাহারা ভােগের জন্যই অর্থ উপার্জন করে। ১২
ভাবে অদ্য ইহা হলাে পাইব আবার।
এই ধন আছে আরাে ধন হইবে আমার।।১৩
এই শত্রু হত হলাে হইবে অপর ।
সিদ্ধ বলী ভােগী সুখী আমিই ঈশ্বর।।১৪
কুলীন ও ধনবান আর কেবা ভবে।
দানে যজ্ঞে সেরা আমি অজ্ঞানত ভাবে।।১৫
মােহজালে সমাবৃত ভ্রান্তচিত্ত যত।
অশুচি নরকে পচে কাম ভােগে রত।।১৬
সরলার্থঃ তাহারা ভাবে- “আজ আমার এই ধন আছে, পরে আমার আরও ধন হইবে।” ১৩ তাহারা ভাবে– “আমার এই শত্রু হত হইয়াছে অপর শত্রুও নষ্ট হইবে। আমি সিদ্ধ, বলবান, ভােগী ও সুখী। আমিই ঈশ্বর।” ১৪ তাহারা অজ্ঞানতাবশত মনে করে “এই পৃথিবীতে আমি কুলীন ও ধনবান। দানে ও যজ্ঞে আমার সমান কেহ নাই ।” ১৫ ভ্রান্তচিত্ত ব্যক্তিগণ মােহজালে সমাবৃত। সর্বদা কাম ভােগে রত থাকে বলিয়া তাহারা নরকে পতিত হয়। ১৬
ধন মান মদ গর্বে গর্বিত যে জন।
বিধি ছাড়ি যজ্ঞ করে যশের কারণ।।১৭
অহংকার বল-দর্প কাম-ক্রোধ বশে।
আত্মপর ভেদ করি আমারই দ্বেষে।।১৮
ধর্মদ্বেষী ক্রূরমতি হেন অধমেরে ।
আসুরী যােনিতে ফেলি তারে বারে বারে।।১৯
আসুরী যােনিতে জন্ম লয়ে মূঢ়মতি।
আমারে পায় না লভে আরাে অধােগতি।।২০
সরলার্থঃ যে ব্যক্তি ধন, মান ও মদগর্বে গর্বিত সে বিধি ত্যাগ করিয়া যশের জন্য যজ্ঞ করে। ১৭ ঈদৃশ ব্যক্তি অহংকার, বল, দর্প, কাম ও ক্রোধবশে আপন পর বােধে আমাতেই ঘৃণা করে। ১৮ ঈদৃশ ব্যক্তি ধর্মদ্বেষী, ক্রূরমতি ও অধম। বারবার তাহার আসুরী যােনিতে জন্ম গ্রহণ করিতে হয়। ১৯ ঈদৃশ মূর্খ ব্যক্তি আসুর যােনিতে জন্ম গ্রহণ করিয়া আমাকে পায় না, আরাে অধােগতি লাভ করে। ২০
ত্রিবিধ নরক-দ্বার আত্ম বিনাশন।
কাম-ক্রোধ-লােভ তিনে করিবে বর্জন ৷ ৷২১
এই তিন দ্বার মুক্ত পার্থ যেই জন।
আত্মশ্রেয়ঃ সাধি পরে পরাগতি হন।।২২
ত্যজিয়া শাস্ত্রের বিধি করে স্বেচ্ছাচার।
সিদ্ধি সুখ পরাগতি কভু নাহি তার।।২৩
কর্মাকর্ম নির্ণয়েতে শাস্ত্রই প্রমাণ।
শাস্ত্র বিধি জেনে কর কর্ম অনুষ্ঠান।।২৪
সরলার্থঃ কাম, ক্রোধ ও লােভ– এই তিনটি নরকের দ্বার, ইহারা আত্মবিনাশক। ইহাদিগকে ত্যাগ কর। ২১ হে অর্জুন, যে ব্যক্তি এই তিনটি দ্বার হইতে মুক্ত, সেই ব্যক্তি আত্মার উন্নতি সাধন করতঃ উত্তম গতি লাভ করেন। ২২ যে ব্যক্তি শাস্ত্রের বিধি ত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচরণ করে, সে সিদ্ধি সুখ ও পরাগতি লাভ করিতে পারে না। ২৩ শাস্ত্রীয় প্রমাণের দ্বারাই কর্ম ও অকর্ম নির্ণয় করিতে হয়। হে অর্জুন, শাস্ত্রের বিধি জানিয়া তুমি কর্ম কর। ২৪
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ষোড়শ অধ্যায়ের সার-সংক্ষেপ
জীব দুই প্রকারের স্বভাব লইয়া জন্ম গ্রহণ করে। একটি দৈব স্বভাব, অরপটি আসুর স্বভাব। ভয়াভাব, চিত্তশুদ্ধি ও আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা প্রভৃতি দৈব স্বভাবের গুণ। আর কাম, ক্রোধ, লােভ প্রভৃতি আসুর স্বভাবের গুণ । দৈব স্বভাব মােক্ষ লাভের সহায়। আর অসুর স্বভাব বন্ধনেরকারণ হয়। শাস্ত্রবিধি অনুসারে আগে কর্তব্যাকর্তব্য নির্ণয় করিতে হইবে । তারপর ধর্ম ও লােক রক্ষার জন্য কর্ম করিলেই দৈব স্বভাব সুপ্রকাশিত হইয়া পরমেশ্বরকে ভজনা করা সহজ সাধ্য হইবে ।
ইতি দৈবাসুর-সম্পদবিভাগযােগ নামক ষােড়শ অধ্যায়।
আরো পড়ুন:
মঙ্গলাচরণ | প্রথম অধ্যায় | দ্বিতীয় অধ্যায় | তৃতীয় অধ্যায় | চতুর্থ অধ্যায় | পঞ্চম অধ্যায় | ষষ্ঠ অধ্যায় | সপ্তম অধ্যায় | অষ্টম অধ্যায় | নবম অধ্যায় | দশম অধ্যায় | একাদশ অধ্যায় | দ্বাদশ অধ্যায় | ত্রয়োদশ অধ্যায় | চতুর্দশ অধ্যায় | পঞ্চদশ অধ্যায় | সপ্তদশ অধ্যায় | অষ্টাদশ অধ্যায় | সংক্ষিপ্ত-মাহাত্ম্যম | সম্পূর্ণ-মাহাত্ম্যম | ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র।
0 মন্তব্যসমূহ