Chapter-13 বাংলায় শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায় | Thirteenth Chapter of Srimad Bhagavad Gita in Bengali

Chapter-13 বাংলায় শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায় | Thirteenth Chapter of Srimad Bhagavad Gita in Bengali


ত্রয়ােদশ অধ্যায়


ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগযােগ


অর্জুন কহিলেন

প্রকৃতি পুরুষ ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ কেশব ।

জ্ঞান জ্ঞেয় কারে কয় কহ মােরে সব।।১

শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন

এ দেহকে ক্ষেত্র বলে শােন ধনঞ্জয় ।

ক্ষেত্রকে যে জন জানে ক্ষেত্রজ্ঞ সে হয়।।২

ক্ষেত্রের ক্ষেত্রজ্ঞ আমি কহিনু তােমায় ।

ক্ষেত্র-ক্ষেত্ৰজ্ঞের জ্ঞান, জ্ঞান বলি তায়।।৩

সরলার্থঃ অর্জুন বলিলেন— হে কৃষ্ণ, প্রকৃতি, পুরুষ, ক্ষেত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, জ্ঞান ও জ্ঞেয় কাহাকে বলে তাহা বুঝাইয়া বল। ১ শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন- হে অর্জুন, এ দেহকে ক্ষেত্র বলে। যিনি ক্ষেত্রকে জানেন তিনি ক্ষেত্রজ্ঞ।২ মনে রাখিও— আমিই ক্ষেত্রের ক্ষেত্রজ্ঞ। ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের জানাই জ্ঞান ।৩


সে ক্ষেত্রের কিবা রূপ কি তার বিকার।

কে হয় ক্ষেত্রজ্ঞ শােন কি প্রভাব তার।।৪

কবিগণ ক্ষেত্ৰতত্ত্ব নানাভাবে গাহে।

ব্ৰহ্মসূত্রে ভিন্ন পদে বলিতেছি তাহে।।৫

মহাভূত অহংকার বুদ্ধি ব্ৰহ্ম আর ।

দশেন্দ্রিয় গােচরের পঞ্চসংখ্যা যার।।৬

ইচ্ছা দ্বেষ সুখ আদি বিকার উদয়।

সংক্ষেপে কহিনু তােমা ক্ষেত্র পরিচয়।।৭

সরলার্থঃ ক্ষেত্রের স্বরূপ এবং ক্ষেত্রজ্ঞের প্রভাব তােমাকে বলিতেছি শােন।৪ পণ্ডিতগণ ক্ষেত্রতত্ত্ব নানাভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছেন। বেদান্তে আবার ভিন্নভাবে ইহার বর্ণনা করা হইয়াছে। ৫ পঞ্চ মহাভূত, দশ ইন্দ্রিয়, রূপরসাদি, পঞ্চ বিষয় ও ইচ্ছাদ্বেষাদি— ইহারাই সংক্ষেপে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রের বিকার ।৬-৭


অমানিতা সহিষ্ণুতা শুদ্ধি সরলতা।

অহিংসা ও গুরু-সেবা প্রাণের স্থিরতা।৮

বিষয়ে বৈরাগ্য পার্থ অহং-ভাব ছাড়া।

জন্ম-মৃত্যু, জরা-ব্যাধি দুঃখে দোষ ধরা।।৯

সংসারেতে অনাসক্তি নিঃস্পৃহতা আর ।

শুভাশুভে সমজ্ঞান কুন্তীর কুমার।।১০

একনিষ্ঠ মন আর নির্জন বসতি।

সঙ্গ-পরিহার আর ভক্তি মাের প্রতি।।১১

আত্মজ্ঞানে থাকি নিত্য কর তত্ত্বার্থ সন্ধান।

জ্ঞান বলে জেনাে তায় তা ছাড়া অজ্ঞান।।১২

সরলার্থঃ হে অর্জুন, অমানিতা, সহিষ্ণুতা, শুদ্ধি, সরলতা অহিংসা, গুরুসেবা, স্থিরতা, বিষয়ে বৈরাগ্য, অহংকার শূন্যতা, জন্ম-মৃত্যু, জরা, ব্যাধি ও দুঃখে দোষ ধরা সংসারে অনাসক্তি, নিঃস্পৃহতা, শুভ-অশুভ সমজ্ঞান, মনের একনিষ্ঠা, নির্জনে বাস, সঙ্গ পরিত্যাগ, আমার প্রতি ভক্তি কর্তৃত্ত্বাভিমান ত্যাগ মােক্ষ সম্বন্ধে ইহারা জ্ঞান ।৮-১২


যাহা হতে অমৃতত্ত্ব জ্ঞেয় যার নাম।

অনাদি পরম ব্রহ্ম নিত্য সনাতন ৷ ৷১৩

হস্ত পদ শির মুখ সর্বত্রই রয়।

সর্বত্র নয়ন কর্ণ সর্বব্যাপী হয়।।১৪

ইন্দ্রিয় প্রকাশ আছে ইন্দ্রিয় বিহীন।

সঙ্গহীন সর্বাশ্রয়ে সগুণ নির্গুণ।।১৫

ভূতে বাহ্যান্তরে ব্রহ্ম ব্যাপ্ত চরাচরে।

সূক্ষ্ম অধিজ্ঞেয় থেকে নিকটে ও দূরে।।১৬

সরলার্থঃ রম বন্ধু অনাদি এবং নিত্য সনাতন।১৩ পরম ব্রহ্ম সর্বব্যাপী। ১৪ তিনি নিঃসঙ্গ অথচ সকলের আধার স্বরূপ। তিনি সগুণ অথচ নির্গুণ। ১৫ তিনি চরাচর বিশ্ব ব্যাপিয়া আছেন। তিনি সূক্ষ্ম ও অধিজ্ঞেয়। তিনি বিষয়ে থাকিয়াও দূরে আছেন। ১৬


সর্বভূতে অবিভক্ত ভিন্নরূপে রন।

বিশ্বস্রষ্টা বিশ্বপিতা প্রলয় কারণ।।১৭

জ্যোতিষ্কের জ্যোতি ব্ৰহ্ম ঊর্ধ্বে তমসার।

জ্ঞেয় জ্ঞানগম্য স্থিত হৃদে সবাকার ।।১৮

ক্ষেত্র জ্ঞান জ্ঞেয় এই কহিনু তােমারে।

এ তিনে জানিয়া ভক্ত পায় যে আমারে।।১৯

প্রকৃতি পুরুষ দুই অনাদি জানিবে ।

প্রকৃতি হইতে গুণ বিকারাদি ভবে।।২০

সরলার্থঃ তিনি সর্বভূতে অবিভক্ত থাকিয়াও ভিন্ন। তিনি বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও সংহার কর্তা। ১৭ ব্ৰহ্ম অন্ধকারের উর্ধ্বে। তিনি জ্যোতিষ্কের জ্যোতি। জ্ঞানের দ্বারাই তাঁহাকে জানতে হয়। তিনি সকলের হৃদয়েই বিদ্যমান আছেন। ১৮ ক্ষেত্র, জ্ঞান ও জ্ঞেয় সম্বন্ধে তােমাকে বলিলাম। ইহা জানিয়া ভক্ত আমাকে প্রাপ্ত হয়। ১৯ প্রকৃতিকে ও পুরুষকে অনাদি বলিয়া জানিবে। এই তিন জানিতে পারিলে ভক্ত আমাকে প্রাপ্ত হয়। বিকারাদি প্রকৃতি গুণ । ২০


কার্য-কারণের হেতু প্রকৃতিই হয়।

কার্য-দুঃখ-ভােগ হেতু পুরুষ নিশ্চয়।।২১

পুরুষ করয়ে ভোগ প্রকৃতির গুণ।

গুণের প্রভাবে ভাল মন্দ জন্ম পান।।২২

সাক্ষীমাত্র মহেশ্বর দ্রষ্টা ভর্তা ভােক্তা।

এ দেহে পরপুরুষ হন পরমাত্মা।।২৩

ত্রিগুণা আকৃতি আর পুরুষ যে জন ।

জানিলে জনম তার না হয় কখন।।২৪

সরলার্থঃ প্রকৃতি কার্য—কারণের কারণ। আর সুখ-দুঃখ ভােগের কারণ পুরুষ। ২১ পুরুষ প্রকৃতির গুণ ভােগ করেন এবং সেই গুণের প্রভাবে ভাল বা মন্দ জন্ম লাভ করে। ২২ পরমেশ্বর স্রষ্টা, কর্তা ও ভােক্তা। তিনি পরমাত্মারূপে সকলের শরীরে বিরাজমান আছেন! ২৩ যে ব্যক্তি প্রকৃতি ও পুরুষকে জানিতে পারে, তাহার আর জন্ম হয় না। ২৪


কর্মযােগে জ্ঞানে ধ্যানে অথবা বুদ্ধিতে ।

আত্মাকে দর্শন করে কিংবা শুদ্ধ চিত্তে।।২৫

পরমুখে শুনি যদি ভজে অজ্ঞজন ।

মৃত্যুভয় হতে তরে শ্রদ্ধার কারণ।।২৬

ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ যােগে জানহ নিশ্চয়।

জ্ঞাত হও তুমি পার্থ সেই সমুদয়।।২৭

সর্বভূতে বিরাজিত পরম-ঈশ্বরে।

নশ্বর এ সংসারে তিনি স্থির রবে।।২৮

সরলার্থঃ কর্মযােগে, জ্ঞানে, ধ্যানে, বুদ্ধিতে কিংবা শুদ্ধচিত্তে আত্মাকে দর্শন করা যায়। ২৫ অজ্ঞান ব্যক্তি অন্যের মুখে শুনিয়াও যদি পরমেশ্বরের উপাসনা করে তথাপি শ্রদ্ধার বলে সে মৃত্যুভয় হইতে রক্ষা পায়। ২৬ হে অর্জুন, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের যােগে স্থাবর জঙ্গমাদি জনিয়া থাকে । ২৭ পরমেশ্বর সর্বভূতে বিরাজ করিতেছেন। নিত্য ও নশ্বরকে যে সমানভাবে দেখে সে-ই প্রকৃতপক্ষে স্থির।২৮


‘ঈশ্বর সর্বত্র সম’ এই জ্ঞান যার।

আত্মহিংসামুক্ত হয় পরাগতি তার।।২৯

প্রকৃতিই সর্বকর্ম সম্পাদিত করে।

তাহা জানি দেখা যায় অকর্তা আত্মারে।।৩০

একেতেই স্থিত আত্মা ভিন্ন ভূতেভাব।

এ জ্ঞান জন্মিলে জেনাে হয় ব্রহ্মলাভ।।৩১

অনাদি অনন্ত পার্থ আত্মা যে অব্যয়।

নিষ্ক্রিয় নির্লিপ্ত তিনি দেহে কভু কর্তা নয়।।৩২

সরলার্থঃ পরমেশ্বর সর্বত্র সমান,—এই জ্ঞান যাঁহার আছে তিনি আত্মহিংসা হইতে মুক্ত হইয়া উত্তম গতি প্রাপ্ত ইন।২৯ প্রকৃতিই সমস্ত কাজ করাইয়া থাকেন। জানিতে পারিলে অকর্তা আত্মাকে দেখা যায়। ৩০ আত্মা এক, কিন্তু তাঁহার ভূতভাব ভিন্ন (অর্থাৎ একই আত্মা ভিন্ন ভিন্ন ভূতে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আছেন)। ইহা জানিলে ব্রহ্মলাভ হইয়া থাকে । ৩১ হে অর্জুন, আত্মা অনাদি, অনন্ত ও অব্যয়। দেহে তিনি কর্তা নহেন, সেখানে তিনি নিষ্ক্রিয় ও নির্লিপ্ত। ৩২


সূক্ষ্মাকাশে থাকি সূর্য নভে লিপ্ত নয়।

দেহে লিপ্ত হয় আত্মা থাকি দেহময়।।৩৩

একমাত্র সূর্য বিশ্বে প্রকাশে যেমন।

একমাত্র আত্মা দেহে বিরাজে তেমন।।৩৪

ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞের ভেদ জীবের প্রকৃতি।

জ্ঞাননেত্রে জেনে পায় মােক্ষ পরাগতি ৷ ৷৩৫

সরলার্থঃ সূর্য যেমন আকাশে থাকিয়াও আকাশে লিপ্ত থাকেন না, আত্মাও সেইরূপ দেহে থাকিলেও দেহে লিপ্ত থাকেন না । ৩৩ এক সূর্য যেমন সমস্ত জগৎকে আলােকিত করে, এক আত্মাও সেইরূপ সকলের দেহকে প্রকাশিত করেন। ৩৪ জ্ঞানের বলে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের ভেদ এবং জীবের প্রকৃতি জানিতে পারিলে মােক্ষ লাভ হইয়া থাকে। ৩৫


শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতার ত্রয়ােদশ অধ্যায়ের সার-সংক্ষেপ

ত্রয়ােদশ অধ্যায়ে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের আলােচনা করা হইয়াছে। দেহকে বলা হয় ক্ষেত্র। ক্ষেত্রকে যিনি জানেন সেই ঈশ্বর ক্ষেত্রজ্ঞ। তিনি আত্মারূপে সকলের দেহেই – বিরাজ করিতেছেন। এই ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞকে জানাই প্রকৃত জ্ঞান। ইহাই পরমেশ্বরের জ্ঞান। এই গুণ লাভ করিতে হইলে অহংকার, শূন্যতা, সরলতা প্রভৃতি সদ্-গুণ অর্জন করিতে হয় । ইহাই জ্ঞানীর লক্ষণ ।

ইতি ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগযোগ নামক ত্রয়ােদশ অধ্যায়।


আরো পড়ুন:

মঙ্গলাচরণ প্রথম অধ্যায় | দ্বিতীয় অধ্যায় | তৃতীয় অধ্যায় | চতুর্থ অধ্যায় | পঞ্চম অধ্যায় | ষষ্ঠ অধ্যায় | সপ্তম অধ্যায় | অষ্টম অধ্যায় | নবম অধ্যায় | দশম অধ্যায় | একাদশ অধ্যায় | দ্বাদশ অধ্যায় | চতুর্দশ অধ্যায় | পঞ্চদশ অধ্যায় | ষােড়শ অধ্যায় | সপ্তদশ অধ্যায় | অষ্টাদশ অধ্যায় | সংক্ষিপ্ত-মাহাত্ম্যম | সম্পূর্ণ-মাহাত্ম্যম | ক্ষমা প্রার্থনা মন্ত্র

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ